প্রচলিত শিক্ষাকাঠামো মানুষের মেধাকে পুরোপুরি বিকশিত করতে পারছে কি? অর্থাৎ যে ছেলেটিকে আমরা শ্রেণিতে প্রথম স্থান দিয়ে থাকি তাকে কি আমরা সাধারণত জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সে রকম অবদান রাখতে দেখি? জাতীয় পর্যায়ে কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যারা অবদান রেখে চলে তাদের একাডেমিক জীবন খুব একটা উজ্জল বা উল্লেখযোগ্য হতে দেখা যায়না। সমাজকে যারা নেতৃত্ব দেয় তারা দেখা যায় ক্লাসে পেছনের সারিতে বসে কিংবা ক্লাসই করেনা কিংবা ক্লাস থেকে কোন এক সময় বহিস্কৃত হয়েছে। আমরা বলে থাকি যে, এ ছেলে ক্লাসে কোনদিন কথাই বলতো না কিংবা কোনদিন ঠিকমতো ক্লাস করেনি আজ সে এতবড় শিল্পপতি কিংবা এতবড় বিজ্ঞানী কিংবা দুনিয়াজোড়া পরিচিত খেলোয়াড়। আসলে তার হওয়ার কথা ছিল খেলোয়াড় কিন্তু আমরা তাকে ডাক্তার বানানোর কথা চিন্তা করে সেভাবে ক্লাস করিয়েছি, ক্লাসে মূল্যায়ন করেছি যা তার মেধা পরিস্ফুটনের বিরুদ্ধে গেছে।
আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’
ভারতীয় তথা বাংলা চলচিত্রের মুক্তিদাতা,সঙ্গীত পরিচালক সত্যজিৎ রায় ভালো স্কুল ও কলেজে পড়াশুনা করে অর্থনীতির স্নাতক হয়েও প্রাতিষ্ঠানকি শিক্ষা তার গড়ে ওঠার পথে তেমনভাবে সহায়ক হয়েছে বলে তিনি কখনো মনে করেননি। শান্তিনিকেতনে কলাভবনের শিক্ষারও আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি তিনি ঘটাননি। তবে সেখানে কয়েকজন শিল্পী-শিক্ষকের সান্নিধ্য এবং দেশি-বিদেশি কয়েকজন বন্ধুর সাহচর্য তার জীবনে মূল্যবান হয়েছিল বলে সত্যজিৎ মনে করতেন। ভারতীয় চিত্রকলা সম্পর্কে আগ্রহের পাশাপাশি সঙ্গীত চর্চার পরিধি-বিস্তার ঘটেছে এ পর্বে।
সেজন্য প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বদলে মেধাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব বাড়ছে। করোনা মহামারি এসে সেই ধারণাকে আরও নতুন মাত্রা দিয়েছে। ফলে, সারা বিশ্বেই এখন শিক্ষা ও সৃজনশীল শিক্ষার ধারণা বদলে যাচেছ। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত অক্সফোর্ড ইউনিভাসির্টির এক সমীক্ষা বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পর্যায়ের চাকরির খাত আগামী ২০ বছরে ৪৭ শতাংশ সংকুচিত হবে যাবে। ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট জানাচেছ আজকের তথ্যপ্রযুক্তির কর্মীরা যে কাজ করছে তার প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ কম্পিউটারাইজড করে ফেলা সম্ভব আর সেটি যদি করাই হয় তাহলে এই খাতের কর্মীরা চাকরি হারাবে। সমীক্ষা বলছে, ভবিষ্যতে চাকরির বাজার বা অর্থপূর্ণ উৎপদানশীল কাজে মানুষের সৃজনশীলতা, কৌতুহল, কল্পনাশক্তি এবং আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন
উদ্ভাবনমূলক অর্থনীতীতে নতুন উদ্ভাবন ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হবে মানবীয় আবেগ ও কল্পনাশক্তি। ঐ সমীক্ষায় আরও বলা হয়, এসব কারণে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বদলে ফেলতে হবে। দুই দশক পরে যে সমস্যা বিশ্ব জুড়ে দেখা দেবে তা মোকাবেলায় পড়াশুনার মডেল বদলানোর বিকল্প নেই। মুখস্থবিদ্যা, পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার বদলে উদ্ভাবনমূলক সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল শিক্ষাব্যবস্থার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এ কারণগুলোর জন্য পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির বাইরে বেশকিছু ধারা গড়ে উঠেছে যেগুলো কিছু দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ ধারাগুলো মূল ধারার অসংগতিগুলোকে তুলে ধরে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় গত তিন দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় করে গড়ে উঠেছে। এখন তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় চারটি স্তর রয়েছে। (ক) স্কুল চয়েস---এ পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে পড়তে চায় তা নির্ধারণ করতে পারবে। (খ) অলটারনেটিভ স্কুল---বিকল্প ধারার এ শিক্ষাপদ্ধতি যা নতুন জীবনদর্শনের ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। তাদের পড়াশুনার ধরণ, বিষয় নির্বাচন, শিক্ষার্থীকে তার নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন, ভাবনার স্বাধীনতা গড়ে তুলতে সহায়তা করে। যেটা প্রথাগত শিক্ষাপদ্ধতিতে থাকেনা। দেখা যাচ্ছে, এই পদ্ধতির লেখাপড়ায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার খুব কম। (গ) ব্যক্তিমালিকানাধীন (ঘ) হোম বেইজড এডুকেশন--এটি আমাদের দেশের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত। এটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই যে, শিশুদের মেধা বিকাশে মুখস্থবিদ্যার বাইরের কিছু প্রয়োজন।
আমাদের সাধারণ শিক্ষাপদ্ধতি তা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। একটি শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও প্রচলিত পরীক্ষার ফল নিয়ে অভিভাবক ও সমাজ যতটা উদ্বিগ্ন তারা ততটা উদ্বিগ্ন নয় তাদের সন্তানের মেধা কতটা বিকশিত হচ্ছে সেটি নিয়ে। মুখস্থবিদ্যা বা অন্যের তৈরি কোন কিছুর হুবহু ব্যবহার বেশ গুরুত্বের সাথে এখনও মূল্যায়ন করা হয়। বিশ্ব কবি তাঁর শিক্ষার বাহন প্রবন্ধে বলেছেন, ‘মুখস্থ করিয়া পাস করাই তো চৌর্যবৃত্তি! যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই বা কম কী করিল?’ তিনি শিক্ষার হেরফের-এ বলেছেন, ‘অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারেনা-বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায়।’ পুরো সমাজ, উচ্চে শিক্ষায় ভর্তি, চাকরি-বাকরি, সমাজে ও প্রতিষ্ঠানে মুল্যায়ন সবই নির্ভর করে প্রাপ্ত ফলের ওপর তাই সবাই যেন উঠেপড়ে লেগে থাকে পুথিগত বিদ্যা অর্জনের জন্য। কিন্তু সেটি যে আখেড়ে সব সময় ভাল ফল দেয়া না সেটি আমরা কমই চিন্তা করি।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এ দেশের শিল্পকারখানার কর্মী চাহিদা পূরণ করতে পারছেনা। প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনায় উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর অভাবে প্রতিবেশী ভারত ও শ্রীলংকাসহ বিদেশি কর্মী নিয়োগে বাধ্য হচ্ছে দেশীয় শিল্পকারখানা। এতে শুধু ভারতেই বছরে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ১০ বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে। বিপরীতে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। দেশের মোট বেকারের ৪৬ শতাংশ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী। প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা বেকার তৈরি করছে বেশি। তাই দ্রুত এ ধারা থেকে বের হতে হবে। দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের চাহিদা জানাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জানতে হবে দেশের প্রয়োজন কী। যুগ ও দেশের চাহিদাকে সামনে রেখে এখনই শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো দরকার। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়, উদ্যোক্তা ও সরকারের সমন্বয় প্রয়োজন। এটি বিচ্ছিন্নভাবে করলে খুব একটা লাভ হয়না। সময়ের চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। ফলে কাঙ্খিত মাত্রায় বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। বিদেশে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এক কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি করে রেখেছে বহুদিন ধরে। জনশক্তি খাত থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে বর্তমানে তা আরও কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের অদক্ষ , কারিগরি জ্ঞান না থাকা অশিক্ষিত কর্মীরা অন্য দেশে দক্ষ অভিজ্ঞ কারিগরি জ্ঞান থাকা কর্মীদের তুলনায় অনেক কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এভাবে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে বাংলাদেশ এখনো অনেকটা পিছিয়ে আছে।
জাপানে শিশুরা পায়ে হেঁটে স্কুলে যায়। প্রায় প্রত্যেক অভিভাবকেরই ব্যক্তিগত গাড়ী আছে কিন্তু সেটি তারা সন্তানের সহপাঠীকে দেখাতে স্কুলে নিয়ে যায়না। জাপানে স্কুল হচ্ছে শিশুদের পরম আনন্দের জায়গা। সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একত্রে বসে খাবার খায়। এখানে শিশুরা বিদ্যালয়ে কেউ অকৃতকার্য হয়না, শিক্ষক দায়িত্ব পালন করতে না পারলে শিক্ষক অকৃতকার্য হন। সুন্দরের পূজা করা আর নৈতিকতা শিক্ষা জাপানের শিক্ষার মৌলিক দিক। ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিক শিক্ষা যার কারণে তাদের মধ্যে মনের মিল আছে, একে অপরের প্রতি ঘৃণা নেই।অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, স্বাধীন চিন্তা ও আত্মনির্ভরশীলতা থেকে জীববৈচিত্রের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়া। বিনয়-শিষ্টাচার, সৌন্দর্যবোধ ও নৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে আত্মিক বিকাশ লাভ জাপানে শিক্ষার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এগুলো আমাদের এখনই করা উচিত। সময় তো অনেক চলে গেল। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘অন্য বই পড়তে গেলে অনেক সময় অনেক বাবা-মা বলেন, ক্লাসের পড়া নষ্ট হচ্ছে। এটি করবেন না। আপনার সন্তানকে ক্লাসের বই ছাড়াও যত বই পড়তে পারে পড়তে দিন। সাহিত্য বা জ্ঞান-বিজ্ঞান হোক, ভ্রমণ কাহিনী , জীবনী, আইসিটির বই পড়তে দিন। পৃথিবীতে যত মানুষ সফল হয়েছে তাদের সবার ডিগ্রি আছে তা কিন্তু নয়। কিন্তু তারা অনেকে বই পড়েছেন। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক বই পড়েছেন। তাই প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হলে আমাদের অনেক বই পড়তে হবে ,শুধু পাঠ্য বই নয়, নানা বিষয়ের বই। চমৎকার কথা বলেছেন মাননীয় মন্ত্রী।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ৬৫শতাংশ শিক্ষার্থী যারা এখন প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে প্রবেশ করছে তাদের যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের বয়স হবে, সে সময়কার কাজ বা বৃত্তি অথবা পেশা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের হবে, যার সম্পর্কে এখন আমাদের কোন ধারণাই নেই। তার মানে হচেছ আর বিলম্ব না করে ঐ সময়ের উপযোগী শিক্ষা আমাদের শিক্ষার্থীদের দিতে হবে তা না হলে তারা আন্তর্জাতিক দৌড় থেকে ছিটকে পড়বে।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, ব্রাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।