পলাতক স্বৈরাচারের রাজনৈতিক দলের অফিস হিসেবে বিদ্যালয়কে ব্যবহার করতেন তিনি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে অন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে কম্পিউটার কেনার কথা বলে ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া এবং সরকারি বই বিক্রি করার অভিযোগও। তিনি রংপুরে পীরগাছায় নটাবাড়ী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর কবীর সরকার।
সম্প্রতি রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়ার পরে এই প্রধান শিক্ষকের অনিয়মগুলো নতুন করে আলোচনায় এসেছে। অভিযোগ দেয়া হয়েছে উপজেলার নিবার্হী কর্মকর্তার কাছে।
অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে রয়েছে হাফ ডজনেরও বেশি জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- অদক্ষতার ফলে এসএসসি পরীক্ষায় ক্রমাগত ফলাফল বিপর্যয়, বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত নৈশপ্রহরী নুরুল ইসলামকে বাদ দিয়ে সবুজ মিয়া নামের একজনকে নিয়োগ, স্কুল ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ, উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ, নিয়োগ বাণিজ্য, আত্মীয়দের নিয়ে গোপন কমিটি গঠন করা।
এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান শিক্ষককে শোকজ করে তার বিরুদ্ধে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ৩ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে। তবে প্রাপ্ত সূত্র অনুযায়ী এখন পর্যন্ত তদন্তের কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি বলে জানা গেছে।
এদিকে অভিযুক্ত সরকার প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নৈশপ্রহরী পদে চাকরি করা নুরুল ইসলামের ওপর নানান রকম অত্যাচার ও নিপীড়নমূলক আচরণ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতারণা আর আশ্রয় নিয়ে রাজনৈতিক অপশক্তিকে ব্যবহার করে প্রধান শিক্ষক পদটি বাগিয়ে নেন। তার চেয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন লোক থাকার পরও, ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ৩ দশমিক ৪৬ সিজিপিএ অর্জন করে এমএ পাস এর মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফলাফলের তুলনামূলক বিবরণীতে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করেন। নিয়োগের পর থেকে তার এম এ ডিগ্রিকে গোপন করে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দের জনবল কাঠামোতে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য নৈশপ্রহরী পদটি সৃষ্টি হলে নুরুল ইসলামের কাছে এমপিওকরণের জন্য মোটা অংকের টাকা দাবি করেন তিনি। কিন্তু গরিব নুরুল প্রধান শিক্ষকের চাহিদা অনুযায়ী টাকার যোগান দিতে না পারায় ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয় বলে জানা যায়।
এ ছাড়াও দৈনিক আমাদের বার্তার হাতে থাকা নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রধান শিক্ষক গোপনে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে তার শ্বশুর মো. শামসুল হককে সমাজসেবক দেখিয়ে সভাপতি করেন এবং পরিবারের লোকজনদের সমন্বয়ে বিদ্যালয়টির পারিবারিক ম্যানেজিং কমিটি গঠন করে যা এলাকাবাসী এমনকি বিদ্যালয়ের অভিভাবক, অন্যান্য শিক্ষকরাও জানেন। এই গোপন কমিটির মাধ্যমে নুরুল ইসলামের পদে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ নভেম্বর সবুজ মিয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়।
শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, নিয়োগ পাওয়ার পর এমপিওভুক্ত হওয়ার দুই মাস পর এই নিয়োগ সম্পর্কে জানতে পারেন তারা।
এছাড়াও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে আরো তিনজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। কাগজপত্র যাচাই করে দেখা যায়, মো. আবু রায়হান নামের একজন বিদ্যালয়ের আরেক সহকারী শিক্ষক ও বারবার শিক্ষক প্রতিনিধি হওয়া প্রধান শিক্ষকের ফুপা শশুর মো. আব্দুল গনি মিয়ার সন্তান। আয়া পদে নিয়োগপ্রাপ্ত মাজেদা খাতুন প্রধান শিক্ষকের শ্যালকের স্ত্রী। আয়া পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী তিনজনই একই পরিবারের সদস্য এবং এই নিয়োগে সভাপতির মেয়ে বাবার নাম পরিবর্তন করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।
অভিযোগের বিষয়ে প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর কবীর সরকারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, উপবৃত্তির টাকা সরাসরি শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনে চলে যায়। সেক্ষেত্রে উপরবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ করার প্রশ্নই ওঠে না বলে জানান তিনি।
নৈশপ্রহরী নুরুল ইসলামকে বাদ দিয়ে সবুজ মিয়াকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি প্রধান শিক্ষক হিসেবে সদ্য নিয়োগ পেয়েছি আগের প্রধান শিক্ষক তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া বৈধ ছিলো না এ ব্যাপারে আগের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে নুরুল ইসলামের রফা-দফা হয়ে গেছে।
দীর্ঘদিন পদটা শূন্য থাকায় যখনই নৈশপ্রহরী নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হয় তখন আমি এলাকাবাসী ও কমিটির সঙ্গে কথা বলে সবুজ মিয়াকে নৈশপ্রহরী নিয়োগ দেই এবং সে এমপিওভুক্ত হয়েছেন।
সব অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে জাহাঙ্গীর কবীর সরকার বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়ায় কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাকে আওয়ামী লীগের দোসর বলেও আখ্যা দিচ্ছেন একটি গ্রুপ। তিনি দাবি করেন, আওয়ামী লীগের আমলেও একটি চক্র তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছেন তাকে জামাত-শিবির বলেও আখ্যা দিয়েছেন।