প্রভাবমুক্ত শিক্ষা ও বলির পাঁঠা শিক্ষক

জ্যোতীশ চন্দ্র রায় |

নিজের সম্ভাব্য সুখস্বাচ্ছন্দ্যের প্রত্যাশায় একটি সম্প্রদায় পাঁঠাবলি দিয়ে থাকেন দেবতাকে উদ্দেশ্য বা উৎসর্গ করে ৷ স্বয়ং দেবতা বা দেবী এমন উৎসর্গে কতটুকু তৃপ্ত হন জানি না, তবে ভক্তকূলের ভূরিভোজটা যুতসইভাবে সম্পন্ন হয় এতে সন্দেহ নেই ৷ আমার আলোচ্যবিষয় পাঁঠাবলি সংক্রান্ত কিছু নয় এবং কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়াও নয়৷ বলির পাঁঠাকে বলির আগে স্নানধ্যান ইত্যাদি করিয়ে, ফুলের মালা গলায় ঝুলিয়ে মস্তবড় খড়গ দিয়ে বলি দেওয়া হয় ৷ বলির আগে পাঁঠার অন্তর-অনুভূতি যে কতোটা বেদনার তা অনুমান করেই কেউ হয়তো ‘বলির পাঁঠা’ প্রবাদটির প্রচলন ঘটিয়েছিলেন যা মূলত সমাজের প্রচলিত অনেক বিষয়ের সাথে মিলে যায় ৷ যাই হোক, বলির পাঁঠা বলতে আমি আমাদের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ইঙ্গিত করেছি ৷ বলাইবাহুল্য, মাননীয় প্রতিষ্ঠান প্রধানরা নিজেদের আবার সরাসরি পাঁঠা ভেবে বসে থাকবেন না, তাহলে আমার অনুতাপের শেষ থাকবে না ৷ দয়া করে মনে রাখবেন শিরোনামের শেষাংশ কিন্তু ‘প্রভাবমুক্ত শিক্ষা৷’

বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ইদানীং দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পর্যন্ত ভাবতে শুরু করেছেন। এটি সময়ের তালে একটি সময়োপযোগী ভাবনা বটে ৷ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন না হলে যে দেশের সকল উন্নয়ন মূল্যহীন- এটি উপলব্ধি করতেই এতসব কথা ৷ করোনার দীর্ঘ দুঃসময় পেরিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলেছে এবং যথাসম্ভব নিয়ম মেনে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানও চলছে ৷ এটি আশাব্যঞ্জক এবং সার্বিক ভালোলাগার একটি বিষয় ৷ সবার অভিযোগ, তদবিরের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হওয়ায় সেখানে মেধাবী শিক্ষকেরা সুযোগ পাননি। যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষাব্যবস্থার এমন লেজেগোবরে পরিস্থিতি ৷ সরকারের উচ্চমহল থেকে শুরু করে অনেকেই এ বিষয়ে বেশ সোচ্চার ৷ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা পদবিজনিত কারণেই সরকার এবং স্থানীয় কমিটির মাঝখানে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেন ৷ সকলের সন্তুষ্টি বিধান করাই প্রধানদের চাকরির অন্যতম অলিখিত চুক্তি বা নিয়ম যা লজ্জাজনক এবং অশুভ ইঙ্গিত বহনকারী একটি প্রক্রিয়া; এ কারণেই নিবন্ধটির শিরোনাম ‘বলির পাঁঠা’ দেওয়া হয়েছে ৷ 

তদবির প্রক্রিয়াটি সংঘটনের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ  সরাসরি জড়িত, যা সর্বজনবিদিত একটি প্রক্রিয়া৷ সরকারি বিধিমালার সাপেক্ষে একটি বিধিভুক্ত কর্তৃপক্ষ নিয়োগপ্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে থাকেন ৷ এরপরেও নিয়োগপ্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ বলাটা কতটুকু যৌক্তিক! যাই হোক, আমাদের দেশে সব ধরনের কথাই বলা যায় এবং সব ধরনের কাজও অবলীলায় করা যায়। আর এক্ষেত্রে আমরা বোবা ও বধির হয়ে দর্শকের ভূমিকা পালন করি মাত্র। জাতি হিসেবে এটি গৌরবের বটে! 

ভালো ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের জন্যে সরকার নিয়ন্ত্রিত নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএর) প্রক্রিয়াটি চলমান আছে। যদিও আইনগত নানাবিধ জটিলতা পেরিয়ে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাজ এগিয়ে চলেছে ৷ তবুও ঘটনাচক্রে শিক্ষক, তদবিরে শিক্ষক এসব বাক্যবাণ সক্রিয় গতিতে চলমান আছে, যা শিক্ষককূলের জন্যে শোভনীয় নয় ৷ দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সঠিক কোনো বিধিমালা আজ পর্যন্ত তৈরিই হয়নি; পরিস্থিতি সাপেক্ষে তড়িঘড়ি করে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন রাতারাতি ঘটাবে, এমন ভাবার সুযোগও নেই ৷ 

মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘মেধাবী শিক্ষক’ হয়ে যান এমন ধারণা কেবল অর্বাচীনেরাই করতে পারেন ৷ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেই শিক্ষক হয়ে গেলেন এটি ঠিক নয় ৷ আমরা অনেকেই মেট্রিক বা আইএ পাস ডিগ্রিধারী ‘অ-মেধাবী’ (বর্তমান ধারণা অনুসারে) শিক্ষকদের ছাত্র। কিন্তু জীবনে শিক্ষার প্রকৃত গোড়াপত্তন সেসব ‘অ-মেধাবী’ শিক্ষকদের হাতেই হয়েছে ৷ আর এসব শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের দ্বারা তাঁদেরই প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। উল্লেখ্য, দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করেছেন স্থানীয় কম মেধাবী বা অশিক্ষিত বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিরা ৷ আমরা সংকট থেকে উত্তরণের পথে উপায় না খুঁজে দায় চাপিয়ে দিতে বরাবরই অভ্যস্ত৷ যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নেন যে, সৃজনশীল পদ্ধতির প্রচলন ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রম চলতে পারে না, তখন সেই ব্যক্তিটির অর্জিত সনাতনী পদ্ধতির গৃহীত সনদগুলো সবার আগে বাতিল করা সঙ্গত নয় কি? আমরা যা বলি তা শুধু বলার জন্যে বলি, পালনের জন্যে নয়। 

শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনে যথাযথ বিধিমালা প্রণয়নই যথেষ্ট নয় ৷ মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন এক্ষেত্রে জরুরি ৷ সার্বিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে না পারা কর্তাব্যক্তিরা যদি বিধির পর বিধি পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করেন তাহলে কস্মিনকালেও শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করা সম্ভব নয় ৷ সর্বোপরি প্রতিষ্ঠান প্রধান বা শিক্ষকরাসহ সংশ্লিষ্টরা যতদিন বলির পাঁঠা হিসেবে থাকবেন এবং বিবিধ প্রভাব থেকে মুক্ত না হবেন ততদিন শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন আসতে পারে না৷ 

লেখক : জ্যোতীশ চন্দ্র রায়, প্রধান শিক্ষক, চিরিরবন্দর, দিনাজপুর।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064380168914795