প্রশাসনে নৈতিকতা

ড. রাজিয়া খানম লাকি |

একটি রাষ্টের কল্যাণের জন্য প্রয়োজন একটা সুষ্ঠু-সুন্দর জন প্রশাসন এবং সুষ্ঠু-সুন্দর জন প্রশাসনের জন্য প্রয়োজন নৈতিক ও মূল্যবোধের দিক নির্দেশনা। এভাবেই গড়ে উঠেছে প্রশাসনিক নীতিবিদ্যা। বর্তমানে বাংলাদেশে আমাদের একান্তভাবেই জরুরি প্রয়োজন সমাজের সর্বক্ষেত্রে প্রশাসনিক নীতিবিদ্যা (নৈতিক মূল্যবোধ বা উচিত-অনুচিতের, ন্যায়-অন্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সমান অধিকারের চেতনা ইত্যাদি) এর প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বর্তমানে আমরা অনেক এগিয়ে গিয়েছি; বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পোশাক, ওষুধ রপ্তানি করা হয়, যা উন্নত প্রযুক্তির মধ্য দিয়েই হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের এই কষ্টার্জিত অর্জনকে মানবকল্যাণে পরিণত করতে হলে সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সুসমন্বিত করতে হবে। আর সমাজ ব্যবস্থার এই দিকটি প্রশাসনের মধ্য দিয়েই বাস্তবায়িত হবে। তাই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নৈতিকতা অর্থাৎ প্রশাসনিক কার্যক্রমের উচিত-অনুচিত দিকগুলোর ক্ষেত্রে সঠিক চিন্তা-চেতনা, প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন আবশ্যক।

মানুষ সামাজিক ও নৈতিক প্রাণি। নৈতিকতা বলতে, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিতের বোধকে বোঝায়। এই নৈতিকবোধ না থাকলে বা পালন না করলে মানুষ নিজেকে নৈতিক বলে দাবি করতে পারে না। আর নৈতিকবোধই পারে পরিবার থেকে সমাজের সর্বস্তরে কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে। কল্যাণ মানেই শান্তি যা মানব জীবনের পরম লক্ষ্য। সকল মানুষই এ লক্ষ্য পূরণ করতে চায়, কিন্তু পারে না শুধুমাত্র অনৈতিকতার কারণে। অনৈতিকতার বিপরীত হলো নৈতিকতা। একটি জাতির উন্নয়ন নির্ভর করে তার অর্থনীতি ও নৈতিক শিক্ষার ওপর এ কথাটি মানুষের অজানা নয় ঠিকই কিন্তু ভোগবাদী মানুষ স্বার্থান্ধেষী চেতনা ধারণ করে বলে ন্যায়-অন্যায়বোধ হারিয়ে ফেলেন। ফলে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয় এবং জীবনের পরম লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই ভয়াবহ নৈতিক সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে। নৈতিক সংকট মানব সভ্যতাকে পর্যুদস্ত করে।

মানব সভ্যতার সংকট চরম রূপ নিয়েছে বিংশ শতাব্দীতেই। দুটি বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে মানুষ হত্যা হয়েছে নির্মমভাবে। বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ আবিষ্কার পারমাণবিক শক্তির জ্ঞান ব্যবহার করা হয়েছে মানুষ হত্যার জন্য এসবই হয়েছে বিজ্ঞানের চরম বিকাশ থেকে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান মানুষকে শক্তি দিয়েছে কিন্তু বিবেক দিতে পারেনি। কারণ, বিবেক আসে নৈতিক আদর্শ থেকে (যা হলো দর্শনের বিষয়)। দুটি বিশ্বযুদ্ধ যখন চরম সংকট তৈরি করেছিলো তখন বিজ্ঞান ও দর্শনের সমান্বিত ভূমিকা কার্যকর ছিলো না। এই সংকট দূরীকরণের জন্য বিজ্ঞান ও দর্শনকে পুনরায় সমন্বিত করা হয়। জীব ও জগতের এমন সমস্যা আছে যার সমাধান বিজ্ঞান করতে পারে না, দর্শন থেকে সহায়তা নিতে হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, চিকিৎসাধীন কোনো রোগী যখন কোমাতে চলে যায় এবং দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরও যদি চেতনা ফিরে না আসে তখন চিকিৎসকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পরেন। কেউ বলেন যে, রোগী বেঁচে আছেন, অন্য কেউ বলেন, রোগী বেঁচে নেই কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার যন্ত্রের সুইচ অফ করে দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতাদর্শ অনুযায়ী, চিকিৎসকরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। কিন্তু  প্রশ্ন থেকে যায় এমন বাস্তবতায় কি করা উচিত হবে? এই প্রশ্ন নৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রশ্ন।   

এক সময় মানুষ দূষিত পরিবেশ থেকে সংগৃহীত খাদ্য সংগ্রহ করে সে খাদ্যের সঙ্গে খেয়েছে ডিডিটি। এখন আমরা মাছ-মাংস, ফলমূলের সঙ্গে কখনো খেয়ে থাকি ফরমালিন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এমন অপপ্রয়োগ থেকে মানুষ মুক্তি পেতে পারে কেবলমাত্র নৈতিকতার অনুশীলন ও প্রয়োগের মাধ্যমে। এভাবে মানব সভ্যতার কল্যাণের লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্যে সহায়ক ও সমন্বিত ভূমিকা নৈতিকতা থেকে আসবে। তাই দর্শন, বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতার যথাযথ সমন্বয়ই হবে মানব কল্যাণ।

বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশাসনিক নীতিবিদ্যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে নৈতিকতার ভূমিকা কার্যকর করার জন্যে। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং প্রশাসনিক অফিসে মোট ৩৪৭টি নৈতিক কেন্দ্র গঠন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে গভর্নমেন্ট এথিক্স শীর্ষক কোর্স প্রচলন হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্যে এবং মিলিটারি এথিক্স কোর্সও প্রচলন করা হয়েছে। আমি মনে করি, বিজ্ঞান ও দর্শন দুটোই আমাদের প্রয়োজন মানব সভ্যতার কল্যণের জন্যে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের বাংলাদেশেও যদি আমরা বিজ্ঞান ও দর্শন (নৈতিক মূল্যবোধ) উভয়কেই গুরুত্ব দেই তাহলে আমরা আমাদের নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শক্তির সঙ্গে যদি দর্শনের মূল্যবোধ ও আদর্শের চেতনা যুক্ত থাকে তবে সেটা মানব কল্যাণের জন্যে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শক্তিকে আরো জোরালো করবে। আমরা আমাদের দেশকে সোনার বাংলা করতে চাই। এ চাওয়া আপামর জনসাধারণের। তাইতো আমাদের কোমলমতি ছাত্ররা নিজের জীবন বিপন্ন করতেও পিছপা হয় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা ৩ কোটি ১৫ লাখ। যে দেশে এতো বিপুল সংখ্যক তরুণ রয়েছে সে দেশের সম্ভাবনা কতো ব্যাপক, যদি সে জনশক্তিকে আমরা ইতিবাচক স্বপ্ন বুনে দিতে পারি এবং নৈতিক ও দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়কে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো বিজ্ঞান ও দর্শনের সমন্বিত প্রয়োগের মধ্য দিয়েই। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফিলোসফি ডিপার্টমেন্ট, তেজগাঁও কলেজ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028550624847412