গ্রাম ও শহরের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি অলঙ্ঘনীয় ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থী হিসেবে অর্থশাস্ত্র অধ্যয়নের সুবাদে সমাজের নানা বৈষম্যের ধারণা পেয়েছিলাম। বিশেষ করে ধনবৈষম্য, শ্রেণিবৈষম্য, গ্রাম ও শহরের বৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈষম্য- এ রূপ নানা বৈষম্যের কথা। আজ সরকারি কলেজের শিক্ষকতা জীবন শেষে অবসর জীবনে শিক্ষাক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান আমার ভাবনার গভীরে স্থান করে নিয়েছে। শনিবার (৬ নভেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, সমকাল পত্রিকায় (১৫ সেপ্টেম্বর) 'শিক্ষা ক্ষেত্রে চাই মেগা প্রকল্প' শীর্ষক এক নিবন্ধে কলামিস্ট ও সাংবাদিক আবু সাঈদ খান লিখেছেন, 'শিক্ষক ঘাটতি কমিয়ে আনতে টেলিভিশন ও অনলাইনে অঙ্ক, ইংরেজি, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে পাঠদান অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ এসব বিষয়ে সব স্কুলে বিশেষ করে গ্রামের স্কুলে অভিজ্ঞ শিক্ষক নেই।' তার ওই মতামতের সঙ্গে সামান্য ভিন্নমত পোষণ করে বলতে চাই, গ্রামের স্কুলে ওই সব বিষয়ে একদম অভিজ্ঞ শিক্ষক নেই তা বলা যায় না, তবে ওই সব বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষক হয়তো সংখ্যায় নগণ্য। তার ওই মতামতে গ্রাম ও শহরের শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের সুস্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে।
থানা সদরের প্রধান বিদ্যালয়সহ গ্রামগঞ্জের শতবর্ষী ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়গুলোতে সেকালের শিক্ষকদের আসনে আজ কারা সমাসীন হয়েছেন তা যারা ভাবতে পারেন, আমার সেই সমবয়সী ও জ্যেষ্ঠজনদের তা উপলব্ধির বিষয়। তখন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অবিস্মরণীয় বাণী আমাদের মনে পড়ে, 'আগের দিনে স্কুল ঘর ছিল কাঁচা কিন্তু শিক্ষক ছিল পাকা, আজ স্কুল ঘর পাকা কিন্তু শিক্ষকগণ কাঁচা।' সেকালে গ্রামের আদর্শবান ও প্রজ্ঞাবান শিক্ষকদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতার আলোতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে আলোকিত হয়েছিল, আজ রাস্তাঘাট, স্কুল ভবন ও বিদ্যুতের আলোঝলমল পরিবেশে তা প্রায় অনুপস্থিত বিবেচিত হয়। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার যথার্থ উন্নয়ন ঘটেনি বরং শহরের তুলনায় গ্রামে তার অবনতি ঘটেছে। শিক্ষকের কাজ যদি হয় শিক্ষার্থীদের জাগ্রত করা, মেধাবীদের শনাক্ত করা, শিক্ষার্থীদের মাঝে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো- সর্বোপরি তাদের স্বপ্টম্ন দেখানো, তাহলে মেধাশূন্য শিক্ষকদের দ্বারা সে কাজটি কীভাবে সুসম্পন্ন হতে পারে?
মনে পড়ে, ষাট ও সত্তরের দশকে বেশকিছু হিন্দু শিক্ষক ভারত গমন করলে গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে অভিজ্ঞ শিক্ষকের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। আবার সত্তরের দশকে অনেক শিক্ষক জাতীয়করণকৃত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে করণিকের পদে যোগদান করার ফলে বিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষকের শূন্যতা সৃষ্টি হতে থাকে। আশির দশকে বেসরকারি খাতের বিকাশ, উপজেলা ব্যবস্থা ও এনজিও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে মেধাবী তরুণদের সেদিকে চোখ যায়। জীবনযাত্রার মান, সামাজিক মর্যাদা, কর্মক্ষেত্রে কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কালক্রমে শিক্ষকরা অবহেলিত হয়ে পড়েন। এসব কারণেই মেধাবী ও নিবেদিতপ্রাণ তরুণরা শিক্ষকতা পেশায় আকর্ষণ অনুভব করে না। স্বাভাবিকভাবেই মেধাবীরা অন্যত্র চলে যাওয়ার পর যারা থাকে, তাদের নিয়েই কোনোমতে কাজ চলতে থাকে। অনেক জেলা শহরে বিগত তিন-চার দশকে কিছু বিত্তবান শিক্ষা-উদ্যোক্তা, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাবী ও যোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে সেখানে কিছুটা উন্নত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যেমন বগুড়া শহরে করতোয়া মাল্টিমিডিয়া স্কুল ও কলেজ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কুল ও কলেজ, বিয়াম মডেল স্কুল ও কলেজ, মিলেনিয়াম স্কলাস্টিক স্কুল ও কলেজ, এস ও এস শিশুপল্লী স্কুল ও কলেজ, ক্যান্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, পুলিশ লাইন্স স্কুল ও কলেজ, গাইবান্ধায় আহমেদ উদ্দিন শাহ্ শিশু নিকেতন স্কুল ও কলেজ ইত্যাদি। এসব বিত্তবানদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জায়গা। সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েরা সেখানে যেতে পারে না। ক্যাডেট কলেজের মতোই ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নত শিক্ষার মানের কারণে গ্রাম ও শহরের শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবধান তৈরি হয়েছে বলে অনুমান করি। তবে গ্রামের সীমিত সংখ্যক বিত্তশালী পরিবার ওই সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ গ্রহণ করছে। কিন্তু তা গ্রামের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ করতে পারে না বা তার ফলে সেকালের মতো গ্রামের ছেলেমেয়েদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় না। আবার জেলা ও উপজেলা শহরে কেজি স্কুলগুলোও সে কাজে সাফল্য লাভ করেছে বলে মনে হয়। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, গ্রামের সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদের সরকারি-বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে, যা ক্রমেই গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির কারণ হয়েছে।
শিক্ষক সমাজের উন্নত জীবনমান ও সামাজিক মর্যাদার নিশ্চয়তা চাই, চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা চাই, যাতে করে দক্ষ, যোগ্য, প্রজ্ঞাময়, সৃজনশীল ও নিবেদিতপ্রাণ তরুণরা শিক্ষকতা পেশায় আকর্ষণ অনুভব করে। অর্থাৎ স্কুল ঘর পাকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বা শিক্ষাব্যবস্থার দৈহিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যেন তার আত্মিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়, তথা দক্ষ শিক্ষক গড়ে তোলা যায়।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, নওগাঁ সরকারি কলেজ