হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও দায়বদ্ধতা নির্ণয়ে অডিট বা নিরীক্ষা কার্যক্রম অতীব গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ পরিদর্শন ও নিরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার পরিচালন ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা যাচাই এবং সরকারী অর্থের যথাযথ ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা সম্ভব। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি পর্যায়ে অডিট কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ব্যয় সংক্রান্ত যে কোন বিল/ভাউচার কর্তৃপক্ষের চ‚ড়ান্ত অনুমোদনের পূর্বে প্রি-অডিট সেল কর্তৃক প্রাক নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ইউজিসি কর্তৃক নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা। তৃতীয়ত, সি জি এ কার্যালয় কর্তৃক গঠিত অডিট কমিটির দ্বারা অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করা। এর বাইরে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন স্বপ্রণোদিত হয়ে নিরীক্ষা কাজটি সম্পন্ন করে থাকে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে যে সমস্ত লেনদেন হয়েছে তা বিভাগের নিরীক্ষা কমিটি কর্তৃক নিরীক্ষাপূর্বক একাডেমিক কমিটির সভায় অনুমোদন করিয়ে ২০০৮-এর সেপ্টেম্বরে আমি পরবর্তী চেয়ারম্যানের নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করি। এমনকি ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন হিসেবে আমি দায়িত্ব পালনকালীন যে সমস্ত লেনদেন হয়েছে তা নিরীক্ষা কমিটি কর্তৃক নিরীক্ষা করে পরবর্তী ডিনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করি। জানতে পেরেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের এ নিরীক্ষা ব্যবস্থাটি এখনও চলমান রয়েছে। রোববার (২৫ জুলাই) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, নিরীক্ষা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থায় কোন ক্রটি আছে কিনা তা শনাক্তকরণ এবং উক্ত ত্রæটি নিরসনে যৌক্তিক পন্থাটি সুপারিশ করা। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে নিরীক্ষক দল কর্তৃক সরকারের আর্থিক বিধিবিধান, নিয়মাচার, অফিস আদেশ, স্মারক, প্রজ্ঞাপন অনুসারে লেনদেনের হিসাবসমূহ যাচাই, বিল/ভাউচারসহ বিভিন্ন আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ডকুমেন্টস পরীক্ষা, অভ্যন্তরীণ অডিট ব্যবস্থার কার্যক্রম মূল্যায়ন, রুটিন অপারেশনাল ক্রিয়াকলাপ পরীক্ষা, জালিয়াতি ও ত্রæটি শনাক্তকরণ, সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক এবং অনার্থিক তথ্য বিশ্লেষণ করে থাকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) উল্লেখ রয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বার্ষিক হিসাব ও প্রাপ্তি এবং পরিশোধ সংক্রান্ত ব্যালেন্সশীট বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সিন্ডিকেট/রিজেন্ট বোর্ডের নির্দেশ অনুসারে প্রস্তুত করে তা ইউজিসির কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিরীক্ষিত হতে হবে। এছাড়া, বার্ষিক হিসাব, নিরীক্ষা প্রতিবেদনের অনুলিপিসহ ইউজিসির মাধ্যমে সরকারের নিকট পেশ করতে হবে। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের হিসাব নিরীক্ষার জন্য তথ্যাদি ইউজিসিতে প্রেরণের লক্ষ্যে একটি চেকলিস্ট প্রস্তুত করে সে অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের তথ্যসমূহ ডাকযোগে অথবা ইউজিসি ইচ্ছা করলে সরাসরি তথ্য সংগ্রাহক দল প্রেরণ করে তথ্যাদি সংগ্রহ করতে পারে। অতঃপর নিরীক্ষার লক্ষ্যে টিম গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগ্রহকৃত তথ্যাদি যাচাই-বাছাইপূর্বক নিরীক্ষার সময় কোন্ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হবে তা নির্ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালযসমূহে নিরীক্ষা দল প্রেরণ করতে পারে। তবে নিরীক্ষক দল প্রেরণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে অবহিত করা প্রয়োজন। নিরীক্ষক দল নিরীক্ষা চলাকালীন কোন আর্থিক কিংবা অ-আর্থিক অনিয়ম নিরীক্ষা দলের দৃষ্টিগোচর হলে তা স্থানীয় অফিসকে প্রাথমিকভাবে আপত্তিগুলো লিখিত আকারে জানায় এবং স্থানীয় অফিস তাৎক্ষণিক জবাব তৈরিপূর্বক তা নিরীক্ষক দলকে প্রদান করে থাকে। নিরীক্ষক দল জবাবে সন্তুষ্ট হলে তা অডিট আপত্তি থেকে বাদ দেয়া হয়।
এভাবে একটি অর্থবছরে সম্পাদিত প্রাথমিক আপত্তিগুলো অডিট কমিটির নিকট উপস্থাপন, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে এক্সিট সভায় বিস্তারিত আলোচনাপূর্বক আপত্তির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। খসড়া আপত্তির ওপর স্থানীয় অফিসের জবাব ব্রডশীট আকারে ইউজিসিতে প্রেরণ করে এবং ইউজিসির সংশ্লিষ্ট শাখার ওই জবাবগুলো পর্যালোচনাপূর্বক আপত্তির নিষ্পত্তির জারি অথবা আপত্তি চ‚ড়ান্তকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করে থাকে। ইউজিসিতে ব্রডশীট আকারে জবাব প্রেরণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আপত্তিসমূহ নিষ্পত্তি না হলে আপত্তি নিষ্পত্তির বিষয়ে ইউজিসির নির্দেশনা বাস্তবায়ন অথবা আপত্তিসমূহ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে পুনঃজবাব প্রেরণপূর্বক ইউজিসির সঙ্গে স্থানীয় অফিসের দ্বিপাক্ষিক সভা আয়োজন এবং তা নিষ্পত্তিকরণ বা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইউজিসি থেকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্থানীয় অফিসের ব্রডশীড আকারে প্রেরিত জবাবগুলো পর্যালোচনাপূর্বক যে সমস্ত আপত্তি নিষ্পত্তি না হয় তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ত্রিপক্ষীয় সভায় নিষ্পত্তির জন্য প্রেরণ করা হয়। উক্ত সভায় যে সমস্ত অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি না হয় তা নিষ্পত্তির জন্য পাবলিক হিসাব সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রেরণ করা হয়।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় চাইলেই নিয়মিত অডিট পরিকল্পনা ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আর্থিক ক্ষেত্রে অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট সেল কর্তৃক গৃহীত প্রি-অডিট কার্যক্রম, ইউজিসির বাজেট মূল্যায়ন টিম কর্তৃক উদ্ঘাটিত অনিয়ম ও আইনানুযায়ী (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) নিরীক্ষা পরিচালনা এবং সরকারী অডিট টিমের মধ্যকার পারস্পরিক সমন্বয় ও সহযোগিতার মাধ্যমে নিরীক্ষা কার্যক্রমের ফলপ্রসূতা ও গতিময়তা অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব যা প্রকারন্তরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে মোট বাজেটের ৯০ ভাগের অধিক অনুদান বাবদ বরাদ্দকৃত জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার সুনিশ্চিত করবে।
লেখক : ড. মোঃ আবু তাহের, সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ডিরেক্টর, বোর্ড অব ডিরেক্টরস, জীবন বীমা কর্পোরেশন, ঢাকা