সুপ্তি আমার প্রতিবেশীর সন্তান। তিন বছর ছয় মাস বয়স। এক বছর বয়স থেকে ওর সঙ্গে আমার সখ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং পদ্মার পারে বেড়ানোর একমাত্র সঙ্গী।
সম্প্রতি নানা কিছু নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে, বিশেষ করে লেখা নিয়ে। একটি বর্ণ লিখে আমাকে লিখতে দেবে। ওর মতো না হলেই শাসন চলে। কান্নাকাটি পর্যন্ত হয়, কেন ওর মতো সুন্দর হচ্ছে না ইত্যাদি। কয়েক দিন আগে বাসায় ঢুকেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী শালার বেটা কেমন আছিস?’ ছোট মানুষের মুখে এমন কথা শুনে মোটেই বিস্মিত হইনি। প্রশ্ন হলো এমন কথা সে কোত্থেকে শিখেছে। প্রথম কারো কাছ থেকে শুনেছে; দ্বিতীয়ত, ইউটিউব থেকে। শনিবার (১৬ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীতে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীতে আরও জানা যায় সুপ্তির মূল আকর্ষণ কার্টুন দেখা। আমার মোবাইল ফোন ওর নিয়ন্ত্রণে থাকে। টিভিতে কার্টুন দেখার চেয়ে মোবাইলে ইউটিউব থেকে নানা কিছু দেখায় তার আগ্রহ বেশি। রিমোটের সাহায্যে টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করার সক্ষমতা সে অর্জন করেনি এখনো। টিভিতে ইউটিউবে কোনো কার্টুন ভালো না লাগলে পরিবর্তন করে দিতে হয়। কিন্তু মোবাইলে সে ইচ্ছামতো পরিবর্তন করে। আমি লক্ষ করে দেখেছি, মোবাইলে কোনো কিছুতে সে পাঁচ মিনিটের বেশি মনোযোগ দিতে পারে না। কোনো কিছু পছন্দ না হলে সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন।
তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বড়দের মতো নানা কিছু শেখে শিশুরা। তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞানের সীমারেখা অনেক কমেছে। সুপ্তি ইউটিউব থেকে ইংরেজি বর্ণমালা শিখেছে। হাম্পটি ডাম্পটি ছড়া গান সে বলতে পারে। লন্ডনে বসবাসকারী আমার বন্ধুর সন্তানটি একই ছড়া একই রকমভাবে বলে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধাভোগী শিশুদের শিক্ষণ প্রশিক্ষণ প্রায় একই রকম। রয়েল স্কুল, গ্রামার স্কুল, আমেরিকান ইন্টারন্যাশল স্কুলের ব্যবধান অনেক কমে যায়। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে পার্থক্য আরো বেড়েছে। আমার পরিচিত একটি শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে কেবল। সে বাংলা পড়তে পারে। বিপরীত চিত্রটি ভয়ংকর। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবার ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়তে ও গুনতে পারার প্রাথমিক দক্ষতার ঘাটতি উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ৩৪ শতাংশ শিশু পড়তে পারে এবং ১৮ শতাংশ শিশু গুনতে পারে; যদিও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান উদ্বেগজনক না হলেও সন্তোষজনক নয়। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমাদের ক্লাসে পড়তে দিয়ে ঘুমাতেন অথবা জমি দেখতে চলে যেতেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব আমরা যারা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছি, তাদের প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। এই অবস্থা থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছি। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্কুলে থাকেন। নিয়মিত ক্লাস নেন। কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। দুর্গম অঞ্চলে বদলি শিক্ষকের ব্যবস্থার কথা মাঝেমধ্যে শোনা যায়। এমএ পাস প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সংখ্যাও অনেক। ভবিষ্যতে এমএ পাস প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সংখ্যার আকার আরো বড় হবে। প্রশ্ন হলো এমএ পাস শিক্ষক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজন রয়েছে কি?
শিশু শিক্ষা একটি বিশেষায়িত শিক্ষা। শিশুর মন প্রাথমিক শিক্ষায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে গেলে সাধারণত আর ফিরে আসে না। শিক্ষকতা একটি বিশেষ পেশা। শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের অন্যতম শর্ত হওয়া উচিত শিশুর প্রতি ভালোবাসা এবং প্রেম। শিশুকে শিশুর মতো করেই ভালোবাসতে হবে। প্রতিটি শিশু যেন শিক্ষককে আপন মনে করে। শিক্ষকের প্রতি শিশুর যেন কোনো ভয় না থাকে। এই শিশুই আগামী দিনের বাংলাদেশ। শিশু শিক্ষায় গলদ থাকলে ভবিষ্যৎ ফল ভালো হয় না।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর পিটিআই থেকে ১৮ মাসের ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন সম্পন্ন করতে হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা সাধারণত শিক্ষকদের চেয়ে একটু ভিন্ন। প্রশিক্ষণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। বছরে কমপক্ষে ১০ দিন হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এমএ, বিএ পাসের চেয়ে পিটিআই থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। পিটিআইগুলোকে সক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিএ সম্মান ও এমএ ডিগ্রির সমকক্ষ করা প্রয়োজন। উপজেলা, জেলা পর্যায়ে বহু কলেজে বিএ অনার্স ও এমএ পর্যন্ত পড়ানো সক্ষম হলে পিটিআইগুলোতে অসুবিধা থাকার কথা নয়। ফলে কাজ হবে দুটি। প্রথমত, যাঁরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চান, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য ভিড় করবেন না; দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক শিক্ষার মান অনেক বৃদ্ধি পাবে।
প্রাথমিক শিক্ষার বিপরীতে মাদরাসা রয়েছে। মাদরাসাকে বাদ দিয়ে হিসাব করলে হবে না। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্র এড়িয়ে যেতে পারে না। মাদরাসা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক গবেষকদের এ ব্যাপারে ভূমিকা কম নয়। কওমি মাদরাসায় বিশেষায়িত শিক্ষার সঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তির জ্ঞান দিতে হবে। প্রতিটি শিশুকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমার, আপনার, সবার।
যেকোনো ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। টিকটকের মতো অশ্লীল ভিডিও জাতির কী কাজে আসে জানি না, তবে শিশুদের কোমল মন ভারাক্রান্ত হয়। টিকটকের মতো ভিডিও নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। রাত ১০টার আগে কোনোভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিকটকের মতো ভিডিও সবার জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত নয়। বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষ এখনো বিদ্যুেসবাবহির্ভূত। বাংলাদেশ সরকার শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য ইন্টারনেট সেবার মান বৃদ্ধি এবং মূল্য হ্রাস করা প্রয়োজন। তথ্য-প্রযুক্তির জ্ঞানসম্পন্ন যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক সৃষ্টির জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
লেখক : ড. মো. আনিসুজ্জামান, সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।