প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বা যুক্তিতর্কের কমতি নেই। বিষয়টি জন গুরুত্বপূর্ণও বটে। এক দিকে যেমন কতিপয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দেশে মানবসম্পদ উন্নয়নে অপরিহার্য অবদান রেখে যাচ্ছে নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে; ঠিক অপর দিকে ভুঁইফোড় কতিপয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে তৈরি করে যাচ্ছে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। তবে ভালমন্দ মিলিয়েই দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা এখন আর থেমে থাকার মতো বিষয় নয়; বরং যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং-এর মাধ্যমে একে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে সচল রাখাই কর্তৃপক্ষের সামনে একটা বড় দায়িত্ব।
জেনারেল এরশাদের স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা ৫ দফা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সেশন জ্যাম সমস্যা তৈরি হয়েছিল তা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী উচ্চ-শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ যেতে শুরু করেন। শুধু ১৯৯১-’৯২ খিষ্টাব্দেই এরূপ প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এতে দেশের কষ্টার্জিত বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়।
অনতিবিলম্বে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইন (১৯৯২) পাশের মাধ্যমে দেশে উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ক্রমান্বয়ে ’৯০-এর দশকেই ওই আইনের আওতায় কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে বেশকিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব হয় এবং বর্তমানে এরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক। যদিও এর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতেই পারেনি।
দেশের উচ্চ-শিক্ষার ক্ষেত্রে এ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট অধ্যয়ণরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ। প্রতি সেমিস্টারে আন্ডারগ্রেড পর্যায়ে নতুন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য মোট আসন প্রায় ১,৮৫,১৫৭ টি এবং গ্রাজুয়েট পর্যায়ে ৯২,৯৮৯ টি। ২০১০-২০১৯ এই দশ বছরে ডিগ্রি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫,৯৪,৭৫৩ জন (সূত্র: ৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৯, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন)। উল্লেখ্য, এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর একটা বিরাট অংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়নি। তারা প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়েও যদি ভর্তি হতে না পারতো তাহলে একদিকে যেমন অপূরণীয় ক্ষতি হতো এদের ব্যক্তিগত জীবনে, অন্যদিকে দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হতো মানব সম্পদের অনাকাঙ্খিত অবক্ষয় ও অপচয়ে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিগত তিন দশকে সংখ্যায় বেড়েছে অনেক, কিন্তু কর দাতাদের টাকায় পরিচালিত হয়ে গুণগত দিক থেকে এদের উন্নতি-অগ্রগতি প্রশ্নসাপেক্ষ। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়েও গর্ব করার আর কিছু অবশিষ্ট্য আছে বলে মনে হয় না। বস্তুতঃ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলেঅর আওতাধীনে রয়েছে বিশাল অবকাঠামোগত ও জনবল সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা এবং রাষ্ট্র বহন করে এদের মোট বাজেটের প্রায় ৯২/৯৩ শতাংশ। সে হিসাবে এদের অবদান কি? পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রীয় কোনো আর্থিক আনুকুল্য বাদেই জনসম্পদ উন্নয়নে যেরূপ সংগ্রাম করে যাচ্ছে তা যথাযথ মূল্যায়নের দাবি রাখে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল সমস্যা দলীয় রাজনীতি। মান সম্পন্ন শিক্ষক-গবেষকের তুলনায় ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করে থাকেন বিশেষ রং (সাদা/নীল/পিঙ্ক) সম্বলিত প্যানেলের তথাকথিত শিক্ষকনেতারা। অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল সমস্যা নিম্নমান সম্পন্ন মালিকশ্রেণির অপেশাদার ও নৈতিকতা বিবর্জিত আচরণ। এদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হলে সামগ্রিকভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে ভ্যাল্যু এডিশনের দিক দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সহজেই অতিক্রম করতে সক্ষম হবে বলে অভিজ্ঞমহলের বিশ্বাস। কেননা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই দলীয় রাজনীতি, নেই করদাতাদের অর্থের অপচয়। তবে এদের টিকতে হবে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিতের মাধ্যমেই।
কতিপয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই যে উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে দেশে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশমুখী না হয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নে উৎসাহী হওয়ায় একদিকে যেমন তারা হচ্ছে উপকৃত, ঠিক দেশও রক্ষা পাচ্ছে সম্ভাব্য অনেক সামাজিক ও আর্থিক সংকটের হাত থেকে। নিরপেক্ষ দেশ প্রেমিক মাত্রেরই দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো (মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, ব্যাক) যথাযথ সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে বিপথগামী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও নিকট ভবিষ্যতে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদন নিশ্চিতে সক্ষম হবে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বহু পূর্বেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠত্ব সংক্রান্ত ভাবনাকে ম্লান করে দিয়েছে। ওসব দেশের শ্রেষ্ঠ সব বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রাইভেট সেক্টরে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় লেজুড় বৃত্তি থেকে মুক্ত করা এবং পেশাদারিত্ব নিশ্চিতের মাধ্যমে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশকে দুর্নীতিমুক্ত করা।
লেখক : প্রফেসর ড. আব্দুল আউয়াল খান, উপাচার্য, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ও সাবেক অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়