শিক্ষার্থী কম থাকায় জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় একীভূত করা অনেকটা মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার সিদ্ধান্তের মতো। নিরাময়ের ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে প্রতি বছর আরো হাজারো হাজারো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংকটে বিলুপ্ত হয়ে পড়তে বাধ্য হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁরই সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মহান উদ্দেশে তৃণমুলের জনগণের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছেন, তা ব্যাহত হবে।
লাভবান হবেন শিক্ষা বাণিজ্যে নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা। এ স্কুলগুলো একীভূত করার উদ্যোগ কোনো অবস্থায় কাম্য নয়। জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বেশিরভাগে সুদর্শন অবকাঠামো উচ্চ শিক্ষিত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সমাহার আছে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বাজেটেরও কমতি নেই। সব সুযোগ-সুবিধা আছে। তারপরেও কেনো শিক্ষার্থীর সংকট? বিষয়টিকে নিয়ে নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে না। সবাইকে এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষার্থী সংকটের কারণগুলোর মধ্যে আছে, শিক্ষক সংকট, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার অভাব বা অবহেলা, যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেনসহ নানা ধরনের মাদরাসা ও বেসরকারি বিদ্যালয় স্থাপন, উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রাথমিক শাখা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কার্যক্রম চালু করা।
প্রাথমিকের শিক্ষক সংকট জন্ম থেকেই ছিলো। এই সংকটের কারণে প্রাথমিক শিক্ষা মান তলানিতে অবস্থান করছে। এ ফলশ্রুতিতে অভিভাবকেরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর আস্থা হারিয়ে তাদের সন্তানদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। শিক্ষক সংকট অব্যাহত রেখে শিক্ষার্থীর সংকটের করুণ অবস্থা দেখিয়ে বিদ্যালয় একীভূত করা কতোটা যৌক্তিক? আশা করি ভেবে দেখবেন।
বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য কোনো সংকট নেই। শুধু দৃশ্যমান নয় শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অবহেলা ও আন্তরিকতার অভাব। এ অবস্থা দূর করতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংকটের জন্য দায়ী শিক্ষক ও দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। শাস্তিমূলক বদলি মতো নামমাত্র ব্যবস্থা গ্রহণ না করে কর্মস্থলে রেখে জবাবদিহিতার মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা সৃষ্টি প্রয়াস চালাতে হবে। কাঙ্ক্ষিত সফলতা লাভ না করলে চাকরিচ্যুতির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিশু শিক্ষার ক্ষতি থেকে মুক্ত রাখার প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে।
যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেন বেসরকারি বিদ্যালয়সহ মাদরাসা স্থাপনের ওপর নজরদারির রাখা প্রয়োজন। সেজন্য অবশ্য একটি নীতিমালা করে দিয়েছে সরকার।
শিক্ষার্থী সংকট কমিয়ে আনতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকালে এক ঘণ্টা ব্যবহারিক জীবনের ধর্ম শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ সময় শিক্ষার্থীরা যার যার ধর্মীয় পবিত্র গ্রন্থ ও ধর্মীয় রীতিনীতির বিষয়ে শিখবেন।
কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে যত্রতত্র বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করে শিক্ষার্থী সংকটের দোহাই দিয়ে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় বিলুপ্ত করা কোনো অবস্থা সমীচীন নয়।
উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রাথমিক শাখা সরকারি পৃষ্ঠপোষতায় চালু করা জরুরি ছিলো না। যেখানে সর্বজনস্বীকৃত ড. কুদরাত-এ খুদা ও তারই আদলে প্রণীত ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর থাকার কথা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত। এক মহা স্বপ্ন নিয়ে প্রণীত শিক্ষানীতি ২০১০ কার্যকর হলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত এদেশের গরিব, মেহনতি সাধারণ মানুষের সন্তানরা অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত হতো। অথচ শিক্ষনীতিকে অকার্যকর করে উল্টো পথে হাটছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দুটি। শিক্ষার্থী সংকটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব বিপন্ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। যা কোনো অবস্থায় কাম্য নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় দীর্ঘ সময় থেকে এ কার্যক্রম চালাচ্ছে। বর্তমান দিন দিন এ ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে।
অপরদিকে, শিক্ষার্থী সংকটে থাকা জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় একীভূত করার অপপ্রয়াস চালচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংকট নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধের বিষয়ের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। প্রথমিক শিক্ষায় তৃণমুলের শিক্ষক, কর্মকর্তাদের কঠোর জবাবদিহিতা, শিক্ষক সংকট দূর করা, যত্রতত্র বেসরকারি বিদ্যালয় বা মাদরাসা গড়ে তোলা থেকে বিরত থাকা ও তা বন্ধ করে দেয়া, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সকাল এক ঘণ্টা নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা, উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ শাখার প্রাথমিক শাখা বিলুপ্ত করা হলে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় একীভূত করা থেকে রেহাই পাবে। আমাদের সকলকে যেকোনো মুল্যে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষার্থী সংকট মোকাবিলার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ