প্রাথমিক বিদ্যালয় (প্রাইমারি স্কুল) আমাদের জীবনের এমন একটা জায়গা যেখানে একবার যায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রাইমারি স্কুল কথাটা বললাম কারণ, যতোবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম মুখে আনি অধিকাংশ বার-ই প্রাইমারি স্কুল বলি। তাই এই স্কুলের প্রতি সবার টান, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা বলে শেষ করা যাবে না, কোনো দামি বা সস্তা বিশেষণে বিশেষায়িত করা যাবে না। সবার জীবনে আবেগে তাড়িত হবার, স্মৃতি জাগানিয়ার জায়গা।
কিন্তু আস্তে আস্তে সেই প্রিয় জায়গা যেনো ফিকে হয়ে যাচ্ছে, নিজের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে পারছে না। শুধু প্রশ্ন বিদ্ধ হয়ে চলেছে, সবার মতো আমারও অবাক লাগছে, কেনো এমন হচ্ছে, এমন তো হওয়ার কথা নয়।
কোনো রকম তুলনা, বিশ্লেষণ, সমালোচনা নয়। সবাই যখন সামনের দিকে মুখ ও মাথা উঁচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা কোনো কিছু না শিখে (ঠিক মতো লিখতে না পারা, বলতে না পারা, পড়তে না পারা) প্রতি বছর এক শ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে অনায়াসে উঠে যাচ্ছি কেউ ঠেকাচ্ছে না কিন্তু ফলাফল শূন্য। তা না এরপর যা হওয়ার তাই হচ্ছে। প্রাইমারি শেষ করেছেন। সে কিন্তু লিখতে, পড়তে ও বলতে পারছেন না।
এবার বলি একজন প্রাইমারি শেষ করা শিক্ষার্থী কেনো পড়তে, লিখতে ও বলতে পারবেন না, ভাবা যায়। কোনো কিছুর তো কমতি নেই। শিক্ষক আছেন, শ্রেণিকক্ষ আছে, ছাত্র/ছাত্রী আছেন, প্রশিক্ষণ আছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট আর যারা আছেন তাদের কথা বলা যাবে না। কেনো না উনারা সংখ্যায় কম। শ্রেণিকক্ষে কী হচ্ছে এগুলো দেখার মতো সময় তাদের বের করা সম্ভব নয়। তবে এর মধ্যে আবার ব্যতিক্রমও কিন্তু আছে।
২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সীমিত আকারে এবং ২০১৩ থেকে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ বছর বয়সি শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দু’বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি পরিচালিত হয়ে আসছে। ২০১০ বা ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সারা দেশে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শিশু বিকাশ কেন্দ্র ও প্রি-প্রাইমারি স্কুল হিসেবে এক বছর মেয়াদি আবার কোথাও কোথাও দুই বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালিত হয়েছে।
সে সময় অনেক শিক্ষককে বলতে শোনা গেছে আমাদের ক্যাচমেন্টের শিশু নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কেনো স্কুল পরিচালনা করবে। আবার অনেক স্কুল তো নিজেদের মতো করে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি পরিচালনার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু কেনো জানি না সফল হতে পারিনি। আমার প্রশ্ন তাহলে কি জবাবদিহিতা না দায়বদ্ধতার ঘাটতি ছিলো।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ যখন নিজেদের ঘাড়ের ওপর পড়ল। সরকার যখন ঘোষণা করলো সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি পরিচালনা করতে হবে, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির যাত্রা শুভারম্ভ হলো, বিচারকের কাঠ গড়ায় প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি। রায় হলো এরা লিখতে পারেন না, পড়তে পারেন না কিন্তু বছর বছর শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়ে, শিষ্ঠাচার ও মুল্যোবোধ বর্জিত হয়ে শিক্ষাগুরুর গায়ে চপেটাঘাত করতে সামান্যতম কুন্ঠাবোধ করছেন না। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দুবছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির পাঠদান শুরু হয়েছে। আমরা কী পারবো শিশুর সঠিক বিকাশ ঘটাতে।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রগুলো পৃথক। তবে নিম্নলিখিত মূল বিষয় সাধারণত দেয়া হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিক বিকাশ; যোগাযোগ (সংকেত ভাষাসহ), কথা বলা এবং শোনা; বিশ্ব জ্ঞান এবং বোধশক্তি; সৃজনশীল এবং নান্দনিক বিকাশ; গাণিতিক
সচেনতা; শারীরিক বিকাশ; শারীরিক স্বাস্থ্য; খেলাধুলা; দলবদ্ধভাবে সম্পাদিত কর্ম; স্ব-সহায়তা দক্ষতা অর্জন; সামাজিক দক্ষতা ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা এবং সাক্ষরতা।
যেকোনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব শিক্ষকের। শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামর্থ্য, দক্ষতা, আন্তরিকতা ও প্রজ্ঞা এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা গবেষক, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষকরা কেবল এ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পারেন। তাই একটি অত্যন্ত সুচিন্তিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা একটি সফল শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত।
শিক্ষাক্রম বিস্তরণ প্রশিক্ষণের সর্বশেষ স্তরে শিক্ষকগণ নিবিড় প্রশিক্ষণ লাভ করবেন। কিন্তু নির্দিষ্ট মেয়াদের একটি মাত্র প্রশিক্ষণ শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষক উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রয়োজন। শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তাই প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও কৌশল থাকতে হবে যেখানে শিক্ষকরা তাদের সমস্যা ও নিজস্ব উদ্ভাবনা মতবিনিময় করে পারস্পরিক সমাধান ও দিক নির্দেশনা পেতে পারেন। এজন্য নির্দিষ্ট মেয়াদ অন্তর অন্তর শিক্ষকদের জন্য রিফ্রেশার্স প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে পারে। রিফ্রেশার্সের পাশাপাশি সাব-ক্লাস্টার পর্যায়ে শিক্ষকদের জন্য পারস্পরিক আলোচনা ও মতবিনিময়ের সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। শিক্ষকের দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক সুযোগ ও সহজলভ্য তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে যেমন, শিক্ষক ম্যাগাজিন প্রকাশ, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছোট ছোট কৌশল বা টিপস শিক্ষকদের কাছে পৌঁছে দেয়া ইত্যাদি।
ওপরের বাস্তবতা দেখে বোঝা যায়, আমরা যতোই গলাবাজি করি না কেনো আসলে গোড়ায় গলদ। একজন শিক্ষক যতোবেশি প্রশিক্ষণ পাবে ততো বেশি নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারবে, শিশুর জন্য ভালো কিছু দিতে পারবেন।
এত কিছুর পরে ও কেন প্রাক-প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে? কারণ, আমরা সবাই জানি, প্রাথমিক বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবাই জানে কিন্তু স্বীকার করে না, শ্রেণিকক্ষ আছে, শিক্ষক আছে, শ্রেণিকক্ষ সাজানো আছে, কিন্তু প্রাণ নেই। ভৌগলিক অবস্থান ভেদে আমার কাছে মনে হয়, জেলা, উপজেলা বা শহরতলী বাদে গাঁয়ে বা অজপাড়াগাঁয়ে শিক্ষক আছে, শ্রেণিকক্ষ আছে কিন্তু শিশু নেই! আর প্রাক-প্রাথমিকে শিশু নেই মানে প্রাথমিক বিদ্যালয়েও শিশু নেই।
অনেকে হয়ত অবাক হবেন আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা ভীষণ খারাপ। অনেক বিদ্যালয় আছে শিক্ষক ৪ জন বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৪০ জন। আমাদের দেশে শিশু নিয়ে কাজ করে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য যে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হলে শিশু শ্রেণি বা প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও পরিচালনা করা উচিত।
লেখক: শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার টেকনিক্যাল অফিসার, বরগুনা