সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭০-৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা ইংরেজি পড়তে পারেন না। গবেষণার নামে সংবাদটি জাতীয়করণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত গভীর ষড়যন্ত্র। যদিও এ মূল্যায়ন সারা দেশের প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক চিত্র নয়। গণস্বাক্ষরতা অভিযানের গবেষণা মতে মাতৃভাষা বাংলা হলেও প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সাড়ে ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারেন না । এ গবেষণা বাছাই নেয়া দুর্গম ও অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষক সংকটে নিমজ্জিত বিদ্যালয়গুলোর খণ্ডচিত্র। এ গবেষণাগুলো বারবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয় তথা প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যদা ও ভবিষতের স্বপ্নকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তাদের কাছ থেকে সমস্যা নিরসনে কোনো সুপারিশ দৃশমান নয়।
তারা বঙ্গবন্ধু ও তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার সরকারিকরণ প্রাথমিক শিক্ষার রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে চলেছেন। এ দৃশ্য যেন, প্রাথমিক শিক্ষকসহ তাদের অভিভাবক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয় অবনত মস্তকে চেয়ে চেয়ে দেখছেন। সব দোষ যেন প্রাথমিক শিক্ষকদের। বছরের পর বছর শিক্ষক সংকটে রেখে শিক্ষকদের চেয়ার ধুলাÑবালিতে বিবর্ণ করে শিক্ষার্থীদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অকৃতকার্যদের দলে। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় মেধাবী সচ্ছল অভিভাবকের সন্তানরা পড়াশোনা করেছেন সরকারি-বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখায়।
অলিতে গলিতে প্রতিষ্ঠিত কিন্ডারগার্টেন ও ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রাথমিক শিক্ষার অকৃতকার্য শিক্ষার্থী নিয়ে পথ চলার আরেকটি কারণ। এ সকল বিদ্যালয়গুলো দুপুর ২টার পূর্বে ছুটি হয় বিধায় শিক্ষার্থীর গোসল বা ফ্রেশ হয়ে গরম খাবার খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম, ঘুম সেরে, ফুরফুরে মেজাজে, বিকেলে খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ পায়। অপরদিকে, প্রাথমিকের ক্লাসের সময়সূচি ৩০ থেকে ৫০ মিনিট। এ সময়সূচি হৃতদরিদ্র, অপুষ্টিতে নিমজ্জিত, অশিক্ষিত অভিভাবকদের সন্তানদের পাঠদানের জন্য যথেষ্ট সহায়ক নয়। এ সময় শিক্ষকরা শ্রেণিতে আসা-যাওয়া, নাম ডাকা, কুশলাদি বিনিময়ের পর শিখন ঘাটতি দূর করার জন্য যথেষ্ট নয়। এ রকম আসা-যাওয়া, ৬-৭টা পিরিয়ড শিশু শিক্ষার্থীর জন্য বিরক্তিকর। নানা কারণে প্রাথমিকে শিখন ঘাটতি বিদ্যমান। বেসরকারি উন্নয়নের নামে গণসাক্ষরতা অভিযানের কাছে শুধু প্রাথমিকের দুর্বলতা চিহ্নিতকরণ ব্যতিরেকে সমস্যা দূরীকরণের ব্যস্তবমুখী কোনো সুপারিশ দৃশ্যমান নয়। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা বেসরকারিকরণের জন্য পদক্ষেপ নেন। সেনাসমর্থিত তত্ত্ববধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপদেষ্টা গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীর সময়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে ব্র্যাকের কাছে হস্তান্তরের আদেশ জারি করা হয়েছিলো। সকল ষড়যন্ত্র তৎকালীন বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির আন্দোলনে সফলতার মুখ দেখেনি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সমারোহ, সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা ও শিশুর স্বর্গরাজের পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও সচেতন অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের ভর্তি করা থেকে বিরত থাকছেন। আর নয় সরকারিকরণ প্রাথমিক শিক্ষার অপবাদ, এবার এর অবসান হোক।
এখন প্রয়োজন প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক চ্যালেঞ্জ দূর করার উদ্যোগ। এ প্রত্যাশার আলোকে কতিপয় চ্যালেঞ্জ দূরীকরণে সুপারিশ উপস্থাপন করা হলো:
• উচ্চবিদ্যালয়, কলেজ শাখার প্রাথমিক শাখা বিলুপ্ত করা প্রয়োজন।
• যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেন ও ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।
• ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বের যাচাই-বাছাইকৃত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সময়ক্ষেপণ না করে জাতীয়করণ করা প্রয়োজন।
• শিখন ঘাটতি দূর করার জন্য শিক্ষক সংকট জিরোতে নামিয়ে আনতে হবে।
• শিক্ষকের শ্রেনির কার্যক্রম (পিরিয়ডের) সংখ্যা কমানো প্রয়োজন। প্রতিটি পিরিয়ডের সময়সূচি ১ ঘন্টা করা। প্রতিদিন ৪ টি পিিিরয়ডের বেশি কাম্য নয়। শিক্ষার্থীর বলাও লেখার যোগ্যতা অর্জনে শিক্ষকদের জবাবদিহীতার আওতায় আনা।
• সরকারি প্রাথমিকের শ্রেণির কার্যক্রম দুপুর ২টার মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে। সপ্তাহে ৫ দিন সকল বিষয় পাঠদানের প্রয়োজন নেই। স্কুলেই পড়া ও লেখার যোগ্যতা অর্জন করিয়ে দিতে হবে।
• প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা চিহ্নিত করে, কার্যক্রম গ্রহণ করে ফলপ্রসু শিখন ঘাটতি দূর করা প্রয়োজন।
শিক্ষক, কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয় সমভাবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অপবাদের গ্লানি দূর করবেন এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ