প্রাথমিক শিক্ষা হলো শিক্ষার ভিত্তি বা রুট। এখান থেকেই একজন ছাত্রছাত্রী তার আদর্শ এবং দৃষ্টিভঙ্গির বীজ বপণ করে। আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাগুলোকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এই দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর সার্বিকভাবে বলা যায়, বেতন গ্রেড, টিফিন ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, পদোন্নতি, শিক্ষার্থী হ্রাস পাওয়া, শিক্ষক সংকট ইত্যাদি সমস্যাগুলো ছাড়াও আরো কিছু সমস্যা রয়েছে।
পদন্নোতি একটি চাকরিতে কাঙ্ক্ষিত বিষয়। প্রত্যেকেই চায় তার যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পর পদন্নোতি পেতে। অথচ প্রাথমিকে যেনো পদন্নোতি একটি দুরাশা মাত্র। চাকরিকাল শেষের দিকেও পদন্নোতি বঞ্চিত প্রাথমিকের অসংখ্য শিক্ষক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্র অনুযায়ী, ১৫ বছরেও পদোন্নতি পাননি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষক। সত্যি কথা হলো, গত কয়েক বছরে প্রাথমিকে বহু মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষক হিসেবে এসেছেন। কিন্তু তাদের অনেককেই ধরে রাখা যায়নি। এর কারণ মেধাবীদের ধরে রাখার মতো একটি বেতন কাঠামো, পদন্নোতির সম্ভাবনা এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় তারা অন্য চাকরিতে চলে গেছেন। অথচ মেধাবীদেরও এই খাতে সবচেয়ে বেশি দরকার।
এটা অত্যন্ত লজ্জার কথা যে আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকেরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী! তাদের গ্রেড-১৩। আর প্রধান শিক্ষকদের গ্রেড-১১। সেক্ষেত্রে একজন মাধ্যমিকের প্রধান শিক্ষকের গ্রেডের সঙ্গে প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের গ্রেডে বিস্তর ব্যবধান এমনকি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকদের থেকেও। এসব শিক্ষক অনার্স-মাস্টার্স যোগ্যতা সম্পন্ন এবং একই পেশায় যদি কেউ সরকারি মাধ্যমিকে চাকরি করেন তাহলে তার থেকেও মূল্যায়ন অনেক কম করা হয় প্রাথমিকের শিক্ষককে। কারণ, সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকেরা দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। নির্বাচনের সময় যখন দায়িত্ব প্রদান করা হয় তখন একজন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক দুই যুগ অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ হওয়া সত্ত্বেও পোলিং অফিসার এবং একজন মাধ্যমিকের শিক্ষক কয়েক বছর চাকরি করে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। এখানেও বৈষম্য! শিক্ষা বিভাগে চাকরি করে এবং একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় কেনো বেতন গ্রেড আলাদা হবে সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন হতে পারে বা উন্নত কোনো দেশে প্রাথমিকের শিক্ষকদের এই গ্রেডে বেতন দেয়া হয় কি না সেটাও বিবেচনা করা দরকার। সুতরাং সবার আগে বেতন গ্রেড বৈষম্য দূর করতে হবে। প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত শিক্ষকতা পেশায় যারাই সেবা দিতে আসবেন তারা যেনো একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় একই বেতন পান সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। গ্রেড বৈষম্য দূর না হওয়ায় চরম অসন্তুষ্ট শিক্ষকেরা। শিক্ষা গবেষকেরা বলছেন, এ অবস্থা চললে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে না। সত্যি কথা হলো, গত কয়েক বছরে প্রাথমিকে বহু মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষক হিসেবে এসেছেন। কিন্তু তাদের অনেককেই ধরে রাখা যায় নি। এর কারণ মেধাবীদের ধরে রাখার মতো একটি বেতন কাঠামো, পদন্নোতির সম্ভাবনা এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় তারা অন্য চাকরিতে চলে গেছেন।
বর্তমান বেতন কাঠামোতে প্রাথমিকের শিক্ষকের জন্য মাসে ২০০ টাকা টিফিন ভাতা বরাদ্দ। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তব। এক মাসে ২০০ টাকায় টিফিন ভাতায় ঠিক কী খাওয়া সম্ভব তা নিয়ে আর আলোচনা না করি। আর ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতাও অনেক কম। কারণ, বর্তমানে চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি এবং ওষুধের মূল্য কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় চারজনের একটি পরিবারের চিকিৎসা ব্যয় মেটানো সম্ভব না। এই দুটি জায়গায় একটু বিবেচনা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় শিক্ষকের সংকট রয়েছে। রয়েছে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক দিয়ে দিনের পর দিন কাজ চালিয়ে নেয়া। এ ছাড়া যে সংকট দেখা যায় সেটি হলো এখানে একজন কেরানি নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। কারণ, প্রতিষ্ঠানে প্রচুর কাজ থাকে যা সহকারী শিক্ষকদের করতে হয়। এর ফলে তাদের শ্রেণিতে মনোযোগ দেয়ায় ব্যঘাত সৃষ্টি হয়। আর প্রধান শিক্ষকের নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে একজন কেরানি এই কাজগুলো করলে সমস্যাগুলো আপাতত সমাধান হয় বলেই মনে হয়। এ ছাড়া একজন সহকারী শিক্ষককে কয়েক ধরনের কাজ করতে হয়। এতো কাজ কমিয়ে যদি কেবল শিক্ষা দেয়ার কাজেই গুরুত্ব দেয়া হয় তাহলে শিক্ষকদের ওপর চাপ কমে যায়।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষকদের পোস্ট থেকে জানা যায়, বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা কমানোর দাবি রয়েছে। কারণ, প্রাথমিকের প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান হলো কিন্ডারগার্টেনসমূহ। একদিকে সেসব স্কুলের কম সময় ক্লাস এবং প্রাথমিকের দীর্ঘ সময় ক্লাস শিক্ষার্থীদের বিরক্তির বা একঘেয়েমির কারণ কি না সেটি রীতিমতো গবেষণার দাবি রাখলেও এ নিয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বিষয়টি ভেবে দেখা প্রয়োজন।
দেশের অনেক উপজেলায় প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর বিস্কুট দেয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে সেটি বন্ধ রয়েছে। শোনা গিয়েছিলো দেশে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য মিড-ডে মিল বা দুপুরের খাবার চালু করা হবে। এই কার্যক্রম অনেকদূর এগিয়ে গিয়েও বর্তমানে থমকে আছে। এর প্রভাব পড়ছে উপস্থিতিতে। যদি মিড-ডে মিল চালু করা যায়, যা পাশ্ববর্তী দেশে রয়েছে তাহলে টেকসই প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব। অতএব অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাথমিক এবং পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিকেও মিড-ডে মিল বাস্তবায়ন করা হোক।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো টেকসই করেছে। এই উপবৃত্তির পরিমাণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কারণ, বর্তমানে শিক্ষা ব্যয় অন্যান্য খরচের সঙ্গে লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উপবৃত্তির পরিমাণও কিছুটা সমন্বয় করা প্রয়োজন।
লেখক: শিক্ষক