বাংলাদেশ যখন ভবিষ্যৎমুখী শিক্ষা সংস্কার নিয়ে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করছে, তখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন, ২০২১ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের শিক্ষা, গবেষণা ও নীতি-নির্ধারণী কার্যক্রমে বিগত ষাট বছর ধরে কাজ করে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান তার ধারাবাহিক কাজের অংশ হিসেবেই মনে করে, এই খসড়া আইন বিষয়ে একটি একাডেমিক বিশ্নেষণ জরুরি। সেই লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এক দিনের কর্মশালার আয়োজন করে। কর্মশালায় ইনস্টিটিউটের সব শিক্ষক অংশগ্রহণ করে এবং তাদের মতামতের ভিত্তিতে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছি। বুধবার (৮ ডিসেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
আমরা দেখছি, অন্যান্য দেশে শিক্ষার্থীর শিখনকে ত্বরান্বিত করা এবং তাকে জীবনব্যাপী ও স্বাধীন শিখনচর্চার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে শিখনের জন্য মূল্যায়ন এবং শিখন হিসেবে মূল্যায়নের ওপর সর্বাধিক জোর দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ- ফিনল্যান্ডে মৌলিক শিক্ষা স্তরে (প্রথম থেকে নবম শ্রেণি) কোনো জাতীয় পর্যায়ের বাধ্যতামূলক মূল্যায়ন বা পরীক্ষা নেই। সেখানে শিক্ষক মূল্যায়ন করেন শিক্ষার্থীর শিখনের উন্নয়নের জন্য। শিক্ষার্থী কর্তৃক স্ব-মূল্যায়নের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। যাতে শিক্ষার্থী নিজেই তার শিখন চাহিদা, সফলতা ও উন্নয়নের ক্ষেত্র চিহ্নিত করে নিজের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। বাংলাদেশের শিক্ষাক্রম রূপরেখাতেও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে শিখনের জন্য মূল্যায়ন ও শিখন হিসেবে মূল্যায়ন। কিন্তু প্রস্তাবিত প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন, ২০২১-এ শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রমে গাঠনিক মূল্যায়ন বা শিখনের জন্য মূল্যায়ন এবং শিখন হিসেবে মূল্যায়ন বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই।
যেসব দেশে প্রাথমিক স্তরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন করা হয়, সাধারণত তার মূল লক্ষ্য হলো- শিক্ষার্থীর শিখনের উন্নয়ন, শিখন পদ্ধতির উন্নয়ন এবং বিদ্যালয় বা শিক্ষাব্যবস্থার জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ; সনদ প্রদান নয়। বেশিরভাগ ওইসিডি দেশে বাধ্যতামূলক জাতীয় পরীক্ষাগুলো উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অনুষ্ঠিত হয়, যেগুলোর উদ্দেশ্য সনদ প্রদান। সেখানে প্রাথমিক স্তরে বা বাংলাদেশের পঞ্চম শ্রেণির সমতুল্য শ্রেণিতে সনদনির্ভর পরীক্ষা নেই। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফল মূলত শিক্ষার্থীর অগ্রগতি সম্পর্কে অভিভাবককে জানানো, শিক্ষার্থীর শিখনে সহায়তা এবং শিক্ষার্থীর প্রয়োজন অনুযায়ী শিখন কৌশল পরিমার্জন করার কাজে ব্যবহূত হয়। সনদ বা পাস-ফেলের উদ্দেশ্যে নয়। প্রস্তাবিত প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন, ২০২১-এর কার্যাবলিতে প্রধানত গুরুত্ব পেয়েছে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ও জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন আয়োজন সংক্রান্ত প্রশাসনিক ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা। কিন্তু এসব সামষ্টিক মূল্যায়নের সঙ্গে শিখনের জন্য মূল্যায়ন এবং শিখন হিসেবে মূল্যায়নের সমন্বয়ে শিক্ষার্থীর শিখন নিশ্চিতকরণ এবং বিদ্যালয় ও শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নের রূপরেখার বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি।
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। বিশেষত প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন নিয়ে গবেষণা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ের মুখস্থনির্ভর সমাপনী পরীক্ষার বিরূপ প্রভাবের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। ফলে শিক্ষা খরচ বেড়েছে। মুখস্থনির্ভর শিখন জেঁকে বসেছে এবং শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা অর্জনে পারদর্শিতার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসদুপায় ও অনৈতিকতার চর্চা বেড়েছে। মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব গবেষণা ও অন্যান্য গবেষণা থেকে এটা স্পষ্ট- অবিলম্বে সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করা উচিত।
প্রস্তাবিত আইনটির লক্ষ্যে বলা হয়েছে, গুণগত শিক্ষা বিতরণের স্বার্থে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন করা প্রয়োজন। যদিও বোর্ডের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের পরিসর মূলত পিইসি পরীক্ষা ও অন্যান্য জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীর প্রান্তিক যোগ্যতা মূল্যায়নকেন্দ্রিক। এ ধরনের প্রান্তিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ফিডব্যাক প্রদান ও শিক্ষার্থীর শিখন উন্নয়নের সুযোগ সীমিত। প্রস্তাবিত আইনে বোর্ডের ২১টি কার্যক্রম বিধিবদ্ধ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯টি মূল্যায়ন ও নিরীক্ষা সম্পর্কিত। বাকিগুলো প্রধানত প্রশাসনিক কার্যাবলি সংক্রান্ত। উপরোল্লিখিত ৯টি কাজের মধ্যে পাঁচটি সরাসরি পিইসি পরীক্ষা সংক্রান্ত, দুটি জাতীয় মূল্যায়ন এবং অপর দুটি মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া সম্পর্কিত।
যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড একটি স্থায়ী বোর্ড বা সংস্থা, এর মাধ্যমে পিইসি পরীক্ষা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও মনোবৈজ্ঞানিক ও শিক্ষাবিদদের দৃষ্টিতে চলমান ও গাঠনিক মূল্যায়ন এই স্তরের শিশুদের জন্য বিশেষ কার্যকর। শিক্ষার্থীর গাঠনিক মূল্যায়ন যা শিক্ষার্থীর চলমান মূল্যায়ন এবং প্রক্রিয়া মূল্যায়নের মাধ্যেমে সম্পন্ন বা অর্জিত হয়, তা এখানে অনুপস্থিত। এ ছাড়াও সামষ্টিক মূল্যায়নে শিক্ষার্থীকে শিখনের স্বীকৃতিস্বরূপ সনদ প্রদান করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীর কোন শিখনে কী ধরনের সমস্যা আছে এবং তাকে কী সমাধান দ্বারা সহায়তা করা যেতে পারে সে সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া কঠিন। শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানো কার্যাবলির সঙ্গে সমন্বিত গাঠনিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন ও এর মান সম্পর্কে বিস্তারিত জানা এবং শিক্ষার্থীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা যায়। তাই শিক্ষার্থীর মানসম্মত শিখন নিশ্চিতকরণে গাঠনিক মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু এই আইনে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের সংকীর্ণ রূপ প্রাধান্য পেয়েছে।
যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা একটি সনদনির্ভর পরীক্ষা। এ ধরনের পরীক্ষা শিশুদের ওপর অত্যন্ত মানসিক চাপ তৈরি করে। তাই শিশুদের মানসিক চাপ নিরসন, তাদের সামগ্রিক ও সুষ্ঠু বিকাশ এবং আনন্দের মধ্য দিয়ে শিক্ষালাভের জন্য অবিলম্বে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার বিকল্প হিসেবে স্কুলভিত্তিক গাঠনিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা থাকাই যথেষ্ট। প্রাথমিক শিক্ষার মূল্যায়ন ব্যবস্থার উন্নয়নে এমন একটি প্রতিষ্ঠান দরকার, যা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে তৈরি হবে। এ ক্ষেত্রে যাদের অংশগ্রহণ থাকা উচিত তারা হলেন শিক্ষা মূল্যায়ন, শিক্ষা গবেষণা, প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষা মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা পরিসংখ্যান, শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, শিক্ষানীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, একীভূত শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও অংশীজন।
শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক ও সুসমন্বিত উন্নয়নে একটি কম্প্রিহেনসিভ শিক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যেখানে শিক্ষাসংক্রান্ত নানা বিষয়, যেমন শিক্ষার রূপকল্প, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কাঠামো, অর্থায়ন, শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতি, মূল্যায়ন, মনিটরিং ও সুপারভিশন, শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের সমন্বয় সাধন, একীভূতকরণ- অর্থাৎ শিক্ষার একটি সামগ্রিক আইনি কাঠামো থাকবে। শিক্ষা মূল্যায়ন ব্যবস্থার উন্নয়নে সব প্রতিষ্ঠানকে সেই কম্প্রিহেনসিভ শিক্ষা আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হালিম, পরিচালক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়