দোষ, ত্রুটি ও অবহেলা, প্রায় সকলের মাঝে বিদ্যমান। এ মহাসত্য উপলব্ধি আমাদের মাঝ থেকে লোপ পেতে চলেছে। ভাবখানা এমন ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের সার্বিক দায়িত্ব যেন শিক্ষকদের। তাদের দায় সবচেয়ে বেশি এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু, শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা, এমনকি প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রী কারোরই যেন এ বিষয়ে তেমন দায় নেই। আমরা অবহেলা, অদক্ষতাসহ নিজেদের দোষ ত্রুটি সম্পর্কে ভাবনাহীন।
শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতিতে যেমন শিক্ষাজীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তেমনি শিক্ষক, কর্মকর্তাসহ মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতেও শিক্ষা ব্যবস্থা কাঙ্খিত সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে সকলের দায়-দায়িত্ব বা উপস্থিতি ছাড়া শুধু শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার্থী উপস্থিতি শতভাগ হলেও শিক্ষক সংকট বা অবকাঠামো সংকট সফলতা ম্লান করে দেয়। এখানে প্রাথমিকের শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের অনুপস্থিতির কারণে শিক্ষার মান বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
প্রত্যেক মানুষের জীবনে প্রত্যহ পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার প্রয়োজন। পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার দীর্ঘ সময় না খেলে আমরা সাধারণত নানা রোগে ভুগবো। স্বাভাবিকভাবে অপুষ্টিতে অকর্মন্য হয়ে বেড়ে উঠবে পরবর্তী প্রজন্ম।
বিগত সময়ে প্রাথমিকে বিপুল সংখ্যক পদ শূন্য রেখে নিয়োগ প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর, মেধাবীরা উচ্চতর বেতন বা অধিক লাভজনক পেশায় চলে যাওয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের অভাবে ভোগেন। তাই শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘসূত্রিতায় প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে ঘাটতি থেকে যায়। দায় এসে পড়ে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর। তারপর আসে মরার উপর খাঁড়ার ঘা। মন্ত্রী, সচিব, ডিজি, অভিভাবকসহ সুধী সমাজও প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর সমকন্ঠে অপবাদ দিতে ভুল করেন না। কিন্তু, বিদ্যালয়ের সমস্যা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করার জন্য সকল স্তরের শিক্ষা অফিসার, মহাপরিচালক, সচিব, মন্ত্রীসহ খোদ প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি কাম্য।
যদিও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নিতে ১ থেকে ৪ বছর সময় ব্যয় হয়। কিন্তু, এ ফাইল জটের জন্য কোন জবাবদিহিতা বা শাস্তি দৃশ্যমান হয় না। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত উন্নীত বেতন স্কেল শিক্ষকদের পেতে ৪ বছর সময়ক্ষেপণ হয়। ১৩তম স্কেলের বেতন পেতে প্রায় ২ বছর ব্যয় হয়। প্রাথমিকের সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব বা গিট্টু লাগানোর প্রবণতা থেকে পরিত্রাণ পেতে শিক্ষকদের আদালতে যেতে হয়।
সহকারী উপজেলা কর্মকর্তাসহ সকল কর্মকর্তা চলতি দায়িত্ব থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে পদোন্নতি পাচ্ছেন। অথচ চলতি দায়িত্বের প্রধান শিক্ষক কবরে বা অবসরে বিদায় নিচ্ছেন। প্রাথমিকের সম্মানিত প্রতিমন্ত্রী, সচিব, ডিজিসহ কর্মকর্তাদের এ নিষ্ঠুর আচরণ হৃদয় বিদারক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অথচ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ক ভাবনা মোটেই শিশুবান্ধব নয়। এজন্য প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের দুপুর ২টা পর বিদ্যালয় ছুটি প্রয়োজন। দুপুরে গরম খাবার খেয়ে বিছানায় বিশ্রাম বা ঘুম প্রয়োজন। বিকাল ৪টায় শিশুরা ক্লান্তিহীন দেহে খেলাধুলা করে বাড়ি ফিরে সুস্থ দেহ মন নিয়ে পড়াশোনা করবে।
বর্তমানের ৪০/৫০ মিনিটের শ্রেণি কার্যক্রম ১ ঘণ্টা করা প্রয়োজন। যাতে শিক্ষক স্কুলের পাঠ স্কুলেই শেষ করতে পারেন। সপ্তাহে ৫ দিন সকল বিষয় না পড়িয়ে ৩/৪ দিন পাঠদান করে শিশুদের ওপর পড়ার চাপ কমানোর মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনমুখী শিক্ষা সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। প্রতিদিনের স্বল্পসময়ের দায়সারা শ্রেণির পাঠদান বন্ধ করতে হবে।
প্রাথমিকের জন্য সবচেয়ে অসম্মানের বিষয় হলো, বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য নেই স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার। ফলে মেধাবীরা এ পেশায় আকৃষ্ট হন না। অপরদিকে অভিজ্ঞতা নিয়ে কর্মকর্তারা তাদের ভাবনা কাজে লাগাতে পারেন না।
এভাবে মেধাবী ও অভিজ্ঞতাবিহীন প্রাথমিক শিক্ষা চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম বেড়ে উঠবে মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে। শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কার্যকর তাৎক্ষণিক উপস্থিতির মাধ্যমেই কেবল গড়ে উঠতে পারে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের প্রাথমিক শিক্ষা।
লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম ও সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ