চীন বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যবইয়ে চায়না ভাষা শেখানোর প্রস্তাব দেয়ার মধ্য দিয়ে চীন তার নয়া নীতি প্রয়োগের চেষ্টা শুরু করল। তাদের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বাংলার শিশুদের চায়না ভাষা শেখার পাশাপাশি চৈনিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি শিখতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এমন প্রস্তাব দিয়েছেন। বুধবার (১২ এপ্রিল) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রভাব ‘বিস্তার’ নীতিতে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে চীন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি, সামরিক এবং শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত। গতকাল প্রাথমিকে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে চীন শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতেই গুরুত্ব দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, চীনা রাষ্ট্রদূতের প্রস্তাবে বাংলাদেশ রাজি হলে বাঙালি শিশুরা চৈনিক সভ্যতা সম্পর্কে জানতে পারবে। চীনা নীতির মধ্যে অন্যতম হল চীনা সংস্কৃতির প্রাধান্য। এটাই তাদের জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রে সমস্ত দেশকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছেন শি জিনপিং। জাতি-ধর্ম ভিন্ন হলেও দেশটিতে মানতে হবে চৈনিক সভ্যতা। এই নীতি মানতে নারাজ দেশটির উইঘুরের বাসিন্দারা। এ কারণে উইঘুরে ঝামেলা লেগে থাকে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কৌশলটি অত্যন্ত নরম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়লেও কোনো দেশেই তার ভাষা পাঠ্যসূচিতে নেই। বাংলাদেশে যদি চীনা ভাষা শেখার কার্যক্রম পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে সেটি হবে চীনা কূটনীতির বিরাট জয়।
তবে সেটা চীনাদের জয় কিনা সেটা বলতে পারেননি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ। গতকাল তিনি বলেন, চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে প্রায়
৩৫ মিনিটের বৈঠক হয়। এ সময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় কি কি বিনিয়োগ করে তার বিস্তারিত জানতে চান। সব শুনে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় চীন কি করতে পারে? জবাবে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিমন্ত্রী ও কর্মকর্তারা বলেন, আসন্ন পিইডিপি-৫ প্রকল্পে চীন বিনিয়োগ করতে পারে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ফিডিং কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করতে পারে।
এ সময় চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময় হতে পারে। এতে প্রাথমিকের শিশুদের চায়না ভাষা শিখতে হবে। চীন সেই ভাষা শেখার কার্যক্রমে সহায়তা করতে পারে।
সচিব বলেন, সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পর্বেই চীনা ভাষা শেখার বিষয়টি রয়েছে। তবে গতকাল থেকে চীনের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে। তারা এখন প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে কী কী করবে তার বিস্তারিত জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাবে। তারপর মন্ত্রণালয় পরবর্তী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
বৈঠকে অংশ নেয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকের শিশুদের চীনা ভাষা শেখার বিষয়টি আমরা নিরুৎসাহিত করে বলেছি, এই ভাষা শেখার প্রয়োজন আপাতত নেই। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় চীন যদি বিনিয়োগ করতেই চায় তাহলে স্কুল ফিডিং কর্মসূচিতে করতে পারে। রাষ্ট্রদূতের কথা শুনে মনে হয়েছে, তারা প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে নেয়া প্রকল্প পিইডিপি-৫ প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে। এখন সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন না শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করবে তা তাদের প্রস্তাবনা না পেলে বোঝা যাবে না।
আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, প্রায় ৩৫ মিনিটের বৈঠকে চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় অন্যান্য দেশ বিশেষ করে আমেরিকা ও জাপান কি কি সহায়তা দিয়েছে তা বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছেন। আমেরিকা, জাপানের কথা জানতে চাওয়ার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, হয়ত চলমান ভূরাজনীতির কোনো কৌশল রয়েছে, যা এবার বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায়ও ঢুকে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, চলমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীনমুখী হওয়ায় বাংলাদেশকে পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষমতাধর দেশ বাড়তি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। ভারতও বাংলাদেশকে সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগে চীনের উদ্যোগের খবরে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন চিন্তা বাড়াল। তাদের মতে, দেশের সরকারবিরোধীরা যখন চীনের সাহায্য পেতে ইঁদূর দৌড় শুরু করেছেন ঠিক সে সময় বাংলাদেশের শিক্ষায় চীনের বিনিয়োগ আনার উদ্যেগ নিয়ে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে, শি জিনপিংয়ের চীন বাংলাদেশ সরকারের পাশে রয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেয়া আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, চীনের রাষ্ট্রদূত গতকাল প্রথমবারের মতো প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। এ সময় আমরাও ছিলাম। চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে বিষয়টি নিয়ে এখনই এত গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। তাদের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাওয়ার পর চুলচেরা বিশ্লেষণ করার মধ্য দিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। তবে এটা ঠিক, স্কুল ফিডিং বা পিইডিপি-৫ প্রকল্পে বিনিয়োগের চেয়ে প্রাথমিকের শিশুদের চীনা ভাষা শেখানোর বিষয়েই রাষ্ট্রদূতের আগ্রহ বেশি মনে হয়েছে।
চীনা রাষ্ট্রদূতের প্রস্তাব মত প্রাথমিকের পাঠ্যবইয়ে চীনা ভাষা শেখানোর কাজ কি শুরু হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেছেন, দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের শিশুদের সাংস্কৃতিক বিনিময় হলে ভাষা শেখার দরকার হতে পারে। তবে এটা পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে শেখানো হবে না, আলাদা করে শেখানো হবে তার ভবিষ্যৎ এখনই বলা যাচ্ছে না। শিক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, চীনা সহায়তা নিয়ে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন ও ডিজিটাল ক্লাসরুম নির্মাণ করা যেতে পারে।