একটি প্রবাদ আছে, ‘ÔJustice delayed is justice denied’ ন্যায় বিচার বিলম্বিত ন্যায়বিচার অস্বীকার করা হয়। প্রাথমিকের সমস্যা দূরীকরণে এই প্রবাদটি যথার্থ। সরকার আসে আর যায়। অথচ প্রাথমিকের সমস্যা আমলাতান্ত্রিক যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়। সরকার তথা মন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের পরিবর্তনের ফলে নতুন বছরের মতো পুরাতন সমস্যা নতুনভাবে লিপিবদ্ধ করে যাত্রা শুরু করতে হয়। এভাবে কেটে যায় সমস্যার মাঝে প্রাথমিক পরিবারের জীবন। সমস্যাগুলো অনেকটা জন্ম থেকে চলে আসছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর ধরে সরকার আসা যাওয়ার মধ্যে আছে। অথচ প্রাথমিকের স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস, বেতন বৈষম্য, পদোন্নতি, শিশুবান্ধব সময়সূচি নিয়ে ভাবনাহীন ভাবে চলছে, সরকারের মন্ত্রী, সচিবসহ কর্তাব্যক্তিরা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিশাল জনগোষ্ঠীর মন্ত্রণালয়। তাদের কার্যক্রমে প্রায় মরি-মরি মানসিকতা। এই বৃহৎ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মন্ত্রণালয় চলবে বুক ফুলিয়ে মরি-মরি মনোভাব নিয়ে নয়। ভাবতে অবাক লাগে গরু, ছাগল, শিক্ষাসহ সব মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস বিদ্যমান। শুধু নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।
ভাবনাহীন ভাবে সুদীর্ঘ বছরগুলো কীভাবে স্বতন্ত্র ক্যাডারবিহীন চলছে শিশু শিক্ষার এ বৃহত্তম মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম। অপরদিকে এই দীর্ঘ সময় বেতন বৈষম্যের যাতাকলে পিষ্ট প্রাথমিকের শিক্ষক সমাজ। সমযোগ্যতাসম্পন্ন অন্যান্য পেশার সরকারি কর্মচারীরা পান ১০ম গ্রেড। অথচ প্রাথমিক সহকারি শিক্ষকেরা পেয়ে থাকেন ১৩তম গ্রেড। কেনো এ বৈষম্য ? প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা অধিষ্ঠিত হয়ে পাচ্ছেন ১১তম গ্রেড। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায় সত্বেও ৯/৩/১৪ খ্রিঃ তারিখ থেকে দশম গ্রেডের বেতন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে চলছেন নিষ্ঠুর নির্দয় প্রাথমিকের মন্ত্রণালয়। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায় নিয়েও চলছে সময়ক্ষেপণের টালবাহানা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব অনেকদিন থেকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত।
তিনি সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেডের যৌক্তিকতা, প্রধান শিক্ষকদের হাইকোর্টের আপিল বিভাগের রায় ও দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় পদোন্নতি কার্যক্রম বন্ধসহ সব সমস্যা সম্পর্কে অবহিত। নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আবেদন নিবেদন, স্মারকলিপি, পত্রিকার সংবাদ, এক কথায় প্রাথমিক শিক্ষার নাড়ি নক্ষত্র সম্পর্কে সচিব অবহিত। কারণ তিনি বিগত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘ সময় থেকে প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আছেন। তার সময়ে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার তৃতীয় ধাপের প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইনসহ ফেসবুকে তুমুল হৈচৈ, প্রশ্নসরবরাহকারীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। অথচ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নীরব ভূমিকা পালন করেছে। সর্বশেষ হাইকোর্টে এ বিষয়ে রিট দায়ের করা হলে, হাইকোর্ট মন্ত্রণালয়কে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিলেন। দিবালোকের আলোর মতো সত্য ঘটনা আড়াল করে প্রশ্নফাঁসের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি তদন্ত কার্যক্রমে বেরিয়ে আসে। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ধামাচাপা দিতে তিনি তৎকালীন মহাপরিচালক (অবসরপ্রাপ্ত) পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তিনি সহকারী শিক্ষকদের ১০ গ্রেড না দেয়ার মানসিকতায় ১২ তম গ্রেডের প্রস্তাব করেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট শিক্ষকদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। কল্যাণট্রাস্ট এখন মহাপরিচালক ও মন্ত্রণালয়ের কল্যাণে নিয়োজিত। প্রাথমিকে অধিদপ্তরের নিয়োগবিধি ২০২৩ শিশু, শিক্ষক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাবান্ধব নয়। এ নিয়োগবিধি তারই সময়ের আইনে পরিণত হয়। বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ভারতে ছাপানোর কাজে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত বলে জানা যায়। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানা বদলি ও পদোন্নতি কাজে অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত বলে গুঞ্জন রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে তার কার্যক্রম শিশু, শিক্ষক ও কর্মচারী তথা কর্মকর্তাবান্ধব নয়। তার কার্যক্রম বেশিরভাগ শিশু শিক্ষার সমৃদ্ধির পরিপন্থী। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকের যৌক্তিক দাবি ১০ম গ্রেড। এ দাবি যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে আর কোনো কর্মকর্তা সচিবের চেয়ে বেশি অবহিত নন। তিনি ১২তম গ্রেডে প্রস্তাব দিতে পারেন। অথচ ১০ম গ্রেড এ প্রস্তাবসহ প্রধান শিক্ষকদের আপিল বিভাগের রায় মোতাবেক কমিটি গঠন করতে হবে কেনো ? প্রাথমিক শিক্ষার অন্যান্য বিষয়ে কমিটি হতে পারে। বিগত সরকার ও কোটা আন্দোলন নিয়ে সময়ক্ষেপণ করেছিলেন। এ সময়ক্ষেপণে সরকারের পতন হয়েছে। সারাদেশের সকল প্রাথমিকের শিক্ষক, সকল সংগঠনের একই চাওয়া সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড। এ যৌক্তিক দাবিতে অনড় প্রতিটি প্রাথমিক শিক্ষক। বৈষম্য নিরসনের প্রত্যয়ে গঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকার। আশাবাদী দাবির যৌক্তিকতা যাচাই করে কমিটির তথা আমলাতন্ত্রের নামে সময়ক্ষেপণ থেকে দূরে থাকবে। এ দাবি সব প্রাথমিক শিক্ষকদের যৌক্তিক প্রাণের দাবি।প্রাথমিকের আরেকটি দাবি আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে ৯/৩/১৪ খ্রিঃ থেকে প্রাথমিক শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড কার্যকর করা। আপিল বিভাগের রায় কার্যকর করতে কেনো মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসময়ক্ষেপণ ?
প্রাথমিক শিক্ষকদের পদোন্নতি সচিব শীঘ্র চালু করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। শীঘ্র বলতে কতদিন, কত মাস, কত বছর ? পদোন্নতি প্রত্যাশীদের প্রশ্ন? প্রাথমিক শিক্ষাকে শিশু বান্ধব ও মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে সহকারী শিক্ষককে পদকে এন্টি ধরে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শতভাগ পদোন্নতিসহ স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডারের সৃষ্টি করা হলে, মেধাবী, দক্ষ, অভিজ্ঞ জনবলে প্রাথমিক শিক্ষা সমৃদ্ধ হবে। নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা প্রাথমিক শিক্ষকরা সরকারি কর্মচারী। তাদের কর্মঘণ্টা হওয়া প্রয়োজন সরকারি কর্মচারীদের মত। তারা শিক্ষকদের কাজের কাঠিন্য সম্পর্কে বিবেচনা করেনা। অপরদিকে শিক্ষক নেতাসহ শিক্ষকরা চান সকাল বেলা বাড়ির কার্যক্রমের শেষ করে গরম খাবার খেয়ে সকাল ১০টায় বিদ্যালয়ে আসবে। বিকাল ৩টায় বিদ্যালয়ের ছুটি হলে আবার বাড়িতে যেয়ে খাবার খাবে। অতঃপর আরাম-আয়েশ বা পারিবারিক কাজ করবে। শিক্ষকবান্ধব সময়সূচি হলো ১০টা-৩টা। শিশুবান্ধব সময়সূচিতে তাদের বিকেলবেলা খেলাধুলা বা বিনোদনের সুযোগ থাকা দরকার। এই সুযোগ নিশ্চিত করতে হলে শিশুদের বিদ্যালয়ের কার্যক্রম ২টার মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে। ২টার মধ্যে শিশুরা বিদ্যালয়ের থেকে বাড়িতে এসে গোসল সেরে বা হাতমুখ ধুয়ে সতেজ হয়ে গরম খাবার খাবে। খাওয়া শেষে খানিকটা বিশ্রাম বা ঘুমানোর পর বিকাল ৪টার দিকে ফুরফুরে মেজাজ, ক্লান্তিহীন দেহ-মন নিয়ে খেলাধুলা, বিনোদন বা ঘুরে বেড়াবে। এতে শিশুর শারীরিক মানসিক বিকাশসহ প্রশান্তি বিরাজ করবে। শিশুদের বর্তমানের মতো ৬ থেকে ৭ পিরিয়ড পাঠদান থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। এই স্বল্প সময়ের পাঠদান শিক্ষকের আসা-যাওয়াসহ শিক্ষা থেকে যথাযথভাবে বিদ্যালয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয় ওঠে না। শিক্ষার্থীদের নোট গাইড, গৃহশিক্ষক বা কোচিংমুখী করা হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রতিটি পিরিয়ডের সময়সূচি ১ ঘণ্টা হওয়া প্রয়োজন।
দৈনিক ৪ টা পিরিয়ডসহ খেলাধুলা, বিনোদন ও কো-কারিকুলামের জন্য সময় থাকা প্রয়োজন। অতিরিক্ত সময় শ্রেণিতে আটকিয়ে রাখলে শিশুর মানসিক ও শারিরীক বিকাশ বিঘ্নিত হয়ে থাকে। পাশাপাশি মাত্রাধিক ক্লাসও শিক্ষকদের মাঝে অবসাদ বা ক্লান্তি নিয়ে আসে। এর ফলে শিক্ষক/শিক্ষার্থীর অতিরিক্ত শ্রেণির পাঠদান শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন ব্যাহত হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক শিক্ষার আমূল পরিবর্তন দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে সংস্কার কমিটি করেছেন। এজন্য ধন্যবাদ। কমিটি তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রস্তাবনা পেশ করবেন। তবে প্রাথমিক শিক্ষার বৈষম্য যা দিবালোকের আলোর মতো পরিষ্কার তা হলো প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের যৌক্তিক ১০ম গ্রেড। প্রধান শিক্ষকদের ০৯/০৩/২০১৪ খ্রিঃ থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় মোতাবেক ১০ম গ্রেড প্রদান। স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিস গঠন। শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে সহকারী শিক্ষকদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া শিশুবান্ধব সময়সূচি দুপুর ২ টার মধ্যে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সমাপ্ত করা। বর্তমান নিয়োগবিধি অনুযায়ী বিএ, অনার্স, মাষ্টার্স মেধাবীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আসছেন। সে প্রেক্ষাপটে সব প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাথমিকের বিএড, কলেজ হিসেবে পরিণত করা হোক। এ দাবিগুলো প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে যে বিশেষজ্ঞ কমিটি হয়েছে তাদের কার্যক্রমের বাইরে আলাদাভাবে খুব শীঘ্রই সমাধান করা হোক। প্রাথমিকের সচিবের নেতৃত্বে দীর্ঘ সময় এ যৌক্তিক দাবিগুলো সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যাবতীয় বৈষম্য দূর করার পরিবেশ তৈরি করা লক্ষ্যে, বিগত সরকারের আর্শীবাদপুষ্ট সচিবসহ তার অনুসারীদের সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন। এতে খুব শ্রীঘ্রই বৈষম্যদুরসহ সংস্কার কার্যকর করা সহজ হবে ।
লেখক: শিক্ষাবিদ