ফিনল্যান্ডের চেয়ে কেন আমরা অধিক সুখী দেশ

মনোয়ার রুবেল |

বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় ফিনল্যান্ড প্রথম হয়েছে!  আমাদের ভাগ্যে জুটেছে একেবারে তলানি থেকে পাঁচ নম্বর।  ঘোর অন্যায় হয়েছে! বদ্বীপের বাসিন্দাদের রোদেপুড়ে চেহারা কৃষ্ণকায় হয়, তা দেখে কাউকে দু:খী মনে হতে পারে, কিন্তু অন্তরে সুখ কী কম? কী মনে হয়, ফিনল্যান্ডে শুধু সুখ আর সুখ? সে হতেও পারে। কিন্তু আমরাও দু:খী নই। কে বা কারা কেনো কিসের ভিত্তিতে আমাদের দু:খী মনে করেছে তা অনুসন্ধান আবশ্যক। স্রষ্টা প্রদত্ত চেহারায় বাঙালি জাতির মুখাবয়বে একটু কালচে ভাব আছে তা সত্যি।  তাই বলে আমরা দু:খী মানুষ হবো কেন? আমাদের সুখ আর ফিনল্যান্ডের জনগণের সুখের উৎস ও কার্যকরণ এক নয়। আমরা যাতে সুখ অনুভব করি,  যাতে চিত্ত আন্দোলিত হয় ফিনল্যান্ডের লোকেদের তা না হতে পারে! মানুষ যা করতে চায়, যেভাবে বেঁচে থাকতে চায় তার নামইতো সুখ, সে সুখে আমরা শতভাগ সুখী।

একজন বিদেশিকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, ‘তোমরা কী রাস্তায় যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে জলত্যাগ করতে পারো?’ 

তিনি বলবেন, ‘না পারি না। কারণ পুলিশ আছে, আইন আছে। আর পারলেও আমরা যেখানে সেখানে একাজ করব কেনো?’

অথচ দেখেন এ কাজগুলোতে আমাদের সুখ।  পরনিন্দা, পরচর্চায় আমাদের সুখলাভ হয়৷ গসিপে আমাদের সুখ হয়। একই বিদেশির সাথে আরও কথোপকথন হোক। 
- তোমরা শহরের যেখানে সেখানে দেয়ালে কবিরাজি দাওয়াখানার পোস্টার সাঁটতে পারো? 
তিনি হয়তো বলবেন, কবিরাজি দাওয়াখানা কী? 
- হারবাল হাসপাতাল।
- এটা আমাদের দেশে করা যায় না। অনুমতি ছাড়া কারো দেয়াল নষ্ট করা অন্যায়।
-  অবাক হচ্ছি, তোমরা নিজেদের সুখী দাবি কর কীভাবে? যদি যথায় তথায় দাঁড়িয়ে পেশশাব না করতে পারো, যদি যার তার গায়ে থুতু দিতে না পারো, তবে সুখী মানুষ কিসের? 
- থুতু দিবে কেন? পুলিশ অ্যারেস্ট করেনা?
- অ্যারেস্ট কেনো করবে! এগুলা কি অপরাধ? এগুলা আনন্দযজ্ঞ। আমরা নিয়মিতই করি।  আমাদের শিশুরা বাসার জানালা দিয়ে প্রায়শই রাস্তায় থুতু ফেলে দেখে কার গায়ে কতটুকু পড়ল! এতে আনন্দ হয়! যারা অলস অকর্মণ্য তারাও আনন্দযোগে এসব কাজ করে। এছাড়া জগতের সুখ কিসে বলোতো!  
-এগুলোতে তোমরা সুখ পাও?
- হ্যাঁ। এদেশে যে যত বেশি পাগলামি করতে পারে সে তত সুখী।  সুখের সর্বোচ্চ স্তরকে আমরা বলি- পাগলের সুখ।  আনন্দের সর্বোচ্চ স্তরকে বলি- পাগলের আনন্দ। বেশি ভালবাসলে বলি, ‘পাগলের মতো ভালোবাসি’। আমাদের সবকিছুতে পাগলামি থাকতেই হয়।
- হালি কাউ!  
- হলি কাউয়ের দেখছো কী? আমাদের দেশের সুখের নীতিগল্প আছে। তোমাদের ঈশপের গল্পের মতো। যে পাগলের জামা নাই, কাপড় নাই, কিছুই নাই সে হচ্ছে গল্পের সুখী মানুষ।

 
- কিন্তু, আমাদের সুখ হচ্ছে দুশ্চিন্তা মুক্ত জীবন। দুশ্চিন্তার মূল কারণ কী জানো? অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা।  আমাদের অর্থবিত্তের অভাব নাই।  তোমাদের আছে। এটাই আমাদের সুখের প্রধান কারণ। 
- কিন্তু, আমাদের দর্শন আলাদা৷  আমরা টাকাকে ঘৃণা করি। অর্থই সকল অনর্থের মূল।  টাকা হলো আমাদের কাছে অত্যন্ত ঘৃণ্য একটি উপাদান। আমারা কবিতা পড়ি, হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান মোরে দিয়েছো খ্রিস্টের সম্মান। 
- ইন্টারেস্টিং। 
- টাকা যদি একমাত্র অথবা প্রধান বিষয় হতো তবে যুক্তরাষ্ট্র বা জাপান কেনো বিশ সেরা সুখী দেশের তালিকায় নেই বলতে পারো?
- না, তা পারিনা। 
- আসল কথা হলো, তোমরা যাকে সুখ বলছো আসলে তা সুখ নয়। সুখের সন্ধান করতে হবে। সুখ কী জানতে হবে।  আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সুখ যদি সুখ নাহি পাও তবে সুখেরও সন্ধানে যাও।’ 
সুখ কি তা নির্ভর করে স্থান কাল পাত্র ভেদে।  তোমার স্ট্যান্ডার্ডে যা সুখ, আমাদের তা সুখ নাও হতে পারে। তোমাদের স্ট্যান্ডার্ডে আমাদের সুখ যাচাই করতে গেলে ভুল রেজাল্ট আসবে। 
  -তোমরা কিসে খুঁজে পাও?
- আমাদের সুখের শেষ নেই। আমাদের প্রধান সুখ হচ্ছে আর একজনকে টেনে নামানোতে। কেউ উপরে যখন উঠে যায় আমরা তাকে টেনে নিচে নামাই! 
-উপরে উঠে গেলে মানে? টু হেভেন?
- আরে না৷ উপরে বলতে খ্যাতিমান৷ কেউ যখন খ্যাতিমান হয়ে যায় আমরা তাকে টেনে নামাই। তখন কি যে সুখ হয় ভাবতেও পারবে না!  পরনিন্দা, পরচর্চা, কানচুলকানো, সবেতে আমাদের সুখ হয়। 
- কি এক বদভ্যাস তোমাদের! 
- সেজন্যই বললাম স্থান কাল পাত্র ভেদে সুখ আলাদা জিনিস। এই যেমন বাদাম খেয়ে তোমরা রাস্তায় খোসা ফেলতে পারো না।  আমরা পারি। আমড়া খেয়ে রাস্তা ময়লা করতে পারি। এসব না করতে পারলে সুখী জাতি কিসের?
- তোমাদের দেশে সবার নিশ্চয়ই সুখের স্ট্যান্ডার্ড এক নয়৷
- সবার আলাদা আলাদা সুখের ব্যবস্থা আছে। যেমন ধরো সাংবাদিক। যা ইচ্ছে তা লিখতে পারেন, এটাতে তার সুখ। নেতা যাচ্ছে ইচ্ছে তাই বাজে বকতে পারেন, এটাতে তার সুখ। হকার যেখানে সেখানে বসে পড়তে পারেন, দোকানদার যখন তখন দাম বাড়াতে পারেন। পুলিশ  যাকে তাকে গ্রেফতার করতে পারেন৷  যখন তখন মিটিং মিছিল ঘোষণা দিয়ে জনপদে বসে পড়া যায়। যে কেউ ডাক্তার সেজে চিকিৎসা দিতে পারে। ছাত্রীকে পরীক্ষায় শূন্য দিয়ে ফেল করানো যায়। ইউটিউবে যা ইচ্ছে বকা যায়।
- মানে যা ইচ্ছা করা যায়?
- তবে আর বলছি কী? যে যেটা করে, যেটায় থেকে সুখ পায় তার সেটা করার সুযোগ থাকাটাই সুখী দেশের লক্ষণ তাই না?
- হ্যাঁ। তোমরা স্বাধীন। স্বেচ্ছাচারও সুখ বটে। তবে আবহাওয়া, আলো, বাতাস, আকাশ পারিপার্শ্বিক সমাজ বসবাসের জন্য কতোটা উপযোগী তাও জানতে হয়?
- দিলেতো ইমোশনাল করে৷ কখনো সবুজ ধান  খেতের মাঝে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছো? বাতাসের শব্দে কানে তালা লেগে যাবে। কখনো কাঠালের আঁঠায় ফাঁদ পেতে শালিক, ময়না ধরেছো? কখনো বর্ষার বারিধারায় টিনের চালের নিচে শুয়ে ঘুমিয়েছো? কখনো ছাতা নিয়ে নৌকা পার হতে হতে নদীর জলে পড়া বৃষ্টি ফোঁটার উচ্ছ্বাস দেখেছো? সন্ধ্যার লাল সূর্য যখন ডুবছে, গরুর পাল নিয়ে হেঁটেছো? এগুলা ফিনল্যান্ডের রাস্তাঘাটের চেয়ে কম সুন্দর? 
- তুমি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছ?
- প্রকৃতির খোঁটা দিলে সিরিয়াস হবোই। আমরা আমাদের মতো করে সুখে আছি, তোমরা তোমাদের মতো। তোমরা আঠারো হলে আলাদা হয়ে পড়ো। আমরা হই না৷ আমাদের বুড়ো মা-বাবা বার্ধক্যেও সন্তানের চুলে বিলি করে দেন, সন্তানের গায়ের ঘ্রাণ নেন৷ আদর করেন। বকা দেন৷ আমরা হাত দিয়ে লোকমা ধরে বৃদ্ধ বাবার মুখে খাওয়ার তুলে দেই। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে?
- আসলেই!
- এটা আমাদের সংস্কৃতি।  এতেই আমরা সুখী৷ তোমার কী মনে হয় আমরা কি সুখী নই? 
- হ্যা, সুখীই তো। 
- তো? 
- কিছু না। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ কেমন হয়?
- অসাম শব্দ হয়! এক বরষায় এসে পড়ো।  চালের নিচে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিও। শুনবে বারিধারার শব্দ যেকোনো সঙ্গীতের চেয়ে মধুর। সর্ষের তেলে মুড়িভাজা খেতে খেতে পুঁথি পাঠকে মনে হবে থিয়েটার। এরপর তোমরা ফিরে গিয়ে আমাদের গল্প বইলো। জানিও সবাইকে সুখ কাকে বলে। 

লেখক : মনোয়ার রুবেল, রম্য লেখক, প্রাবন্ধিক

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052909851074219