ফেসবুক ভেরিফাইডের নামে ভয়ঙ্কর প্রতারণা, গ্রেফতার ১

নিজস্ব প্রতিবেদক |

তেইশ বছর বয়সী হৃদয় আহম্মেদ একজন শিক্ষার্থী। থাকেন মিরপুর-১ নম্বরের দক্ষিণ পাইকপাড়ায়। হৃদয় একদিন তার ফেসবুক আইডি খুলে একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পান। যেখানে লিখা ছিল মাত্র ১০ হাজার টাকায় ফেসবুক আইডি বা পেইজ ভেরিফাইড করে দেয়া হয়। চার্লস আন্ড্রেস ব্রিম নামের যে আইডি থেকে বিজ্ঞাপনটি দেয়া হয়েছিল সেটিও ছিল একটি ফেরিফাইড পেইজ। হৃদয় তার ৬৭ হাজার ফলোয়ারের আইডি ভেরিফাইড করার জন্য ওই আইডির মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠান। কানাডিয়ান নাগরিক পরিচয় দেয়া ওই ব্যক্তি হৃদয়ের কাছে তখন ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। দেরি না করে হৃদয় ওই ব্যক্তির দেয়া একটি বিকাশ নম্বরে ১০ হাজার পাঠিয়ে দেন।

পরে ওই ব্যক্তি ভেরিফাইডের সাপোর্টিং হিসাবে হৃদয়ের কাছ থেকে তার ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড নিয়ে যায়। এরপর আইডিটির পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে তার কাছে। নাম ঠিকানাসহ সকল তথ্য মুছে আইডির মালিক বনে যায় প্রতারক ওই ব্যক্তি। আইডি ফেরত চাইলে সে বলে এক লাখ টাকা দিলে ফেরত দেয়া হবে। পরবর্তীতে অনেকবার যোগাযোগ ও অনুরোধ করার পরও আর আইডি ফেরত পাননি হৃদয়। উপায়ান্তর না পেয়ে হৃদয় আশ্রয় নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর।

শুধু হৃদয় নয়, একই অবস্থা হয়েছিল মেহেদি হাসান নামের আরেক ব্যক্তির। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে তার ব্যক্তিগত আইডি ভেরিফাইডের চেষ্টা করছিলেন। পরামর্শ চেয়ে একটি গ্রুপেও যোগাযোগ করেছিলেন। পরে গ্রুপের এক সদস্য তাকে ইনবক্সে কথা বলার অনুরোধ করেন। ইনবক্সে যোগাযোগ করলে ওই সদস্যও নিজেকে কানাডিয়ান নাগরিক হিসাবে পরিচয় দিয়ে মেহেদি হাসানকে ১০ হাজার টাকা পাঠানোর কথা বলেন। টাকা পাঠানোর পর মেহেদিকে বলা হয় চারদিন পর যোগাযোগ করার জন্য। চার নম্বর দিন তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে মেহেদি জানতে পারেন ওই ব্যক্তি একজন প্রতারক। তাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার টিম গ্রেফাতার করেছে।

গ্রেফতার প্রতারক সৈকত। ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুক ভেরিফাইয়ের নামে প্রতারক চক্র সম্প্রতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই চক্রের সদস্যরা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। চক্রের ফাঁদে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম এমন এক প্রতারককে গ্রেফাতারকরেছে। তার নাম মো. সৈকত মিয়া। বাড়ি নরসিংদীতে। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার সৈকত মূল পেশার বাইরে এসে দীর্ঘদিন ধরে এরকম প্রতারণা করে আসছে। প্রতারণার টাকা দিয়ে নিজের পরিবারের ধার-দেনা পরিশোধ করে হয়েছে স্বাবলম্বী। অভাব-অনটন দূর করে বেশকিছু জমিজমা বন্ধক নিয়েছে। রাতারাতি তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন দেখে এলাকাবাসী ধোঁয়াশায়। সৈকত ডিবির কাছে গ্রেফাতার পর বেরিয়ে আসছেন একের পর এক ভুক্তভোগী। 

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১২ সালের শেষের দিক থেকে এই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সৈকত। পাঁচশ’ ডলার দিয়ে মিশরীয় চক্রের কাছ থেকে কানাডিয়ান এক নাগরিকের নামে খোলা একটি ভেরিফাইড আইডি কিনে ব্যবহার করছিল। মূলত এই আইডি দিয়েই তার প্রতারণা চালিয়ে আসছিল। ভেরিফাইড ওই আইডির মাধ্যমে বিজ্ঞাপন করে মানুষকে প্রলুব্ধ করতো। কেউ আইডি ভেরিফাইড করতে রাজি হলে তার কাছ থেকে টাকা ও পাসওয়ার্ড নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করতো। পরে আইডি সঠিক নিয়ম মেনে থার্ডপার্টির মাধ্যমে ভেরিফাই করে নিতো। ভেরিফাই হলে ওই আইডি ৪০০/৫০০ ডলারে অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দিতো।

ডিবি জানিয়েছে, মিশর, লিবিয়া, তিউনেশিয়া মরক্কসহ আরো কিছু দেশে কিছু চক্র গড়ে উঠেছে। তারা ভেরিফাইড আইডি-পেইজ কেনাবেচা করে। এছাড়া তারা টাকার বিনিময়ে ফেসবুকের মাধ্যমে আইডি ভেরিফাই করে দেয়। সৈকত মূলত এসব চক্রের কাছ থেকে আইডি কিনে প্রতারক হয়ে উঠেছে। যে আইডি দিয়ে সে প্রতারণা করতো সেটি ছিল ‘চার্লস আন্ড্রেস ব্রিম’। বিদেশি নাম এবং অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলায় কেউ বুঝতো না নরসিংদীতে বসে প্রতারণা করছে। সৈকত ছাড়াও এরকম অনেক প্রতারক একই কায়দায় মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষক, চিকিৎসক, মডেল, অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পীসহ আরো অনেকেই তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
ভুক্তভোগী মেহেদি হাসান বলেন, মেসেঞ্জারে সৈকত এমনভাবে ইংরেজিতে কথা বলে বোঝার উপায় নেই সে বাংলাদেশি না কানাডিয়ান। তার কৌশলের কাছে যে কেউ হার মানতে হবে। চ্যালেঞ্জ করে বলে কয়েকদিনের ভেতরে যেকোনো আইডি বা পেইজ ভেরিফাই করিয়ে দিবে। হৃদয় আহমেদ বলেন, যখন দেখলাম আমার আইডির পাসওয়ার্ডসহ অন্যান্য তথ্য মুছে নতুন তথ্য দেয়া হয়েছে। এছাড়া আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে তখন বুঝলাম সৈকত প্রতারক। ছদ্মবেশে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে।

ডিবির সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, থার্ডপার্টির মাধ্যমে পেইজ ভেরিফাইয়ের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হতে হবে। ভেরিফাইয়ের জন্য পাসওয়ার্ড চাওয়া হলে আগে অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে। কারণ কিছু প্রতারক ভেরিফাই করে দেয়ার কথা বলে শুধু টাকাই নয় ভুক্তভোগীর আইডি নিজের কব্জায় নিচ্ছে। সেটা যে-কারো কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। এই আইডি ব্যবহার করে যদি কোনো ধরনের ক্রাইম হয় তবে সেই দায়-দায়িত্ব আইডির মূল মালিককে নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, ফেসুবক আইডি ও পেজের মাধ্যমে এখন অনেকেই অনলাইন ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। অনেকের রুটি-রুজি এখানে জড়িত। কিন্তু যখন কেউ পেইজের মাধ্যমে প্রচারণা বা লাইভ করে তখন কিছু মানুষ সেটিকে স্পাম করে দেয়। এতে করে লাখ লাখ লাইকের পেইজগুলোর রিচ কমে যাচ্ছে। কিন্তু ভেরিফাইড করা থাকলে সেটিকে আর স্পাম করা যেত না।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030980110168457