ফোকলোর গবেষকের আড়ালে অধ্যাপক খালেকের কদর্য রূপ

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল খালেক। দেশে ফোকলোর চর্চায় তার বিশেষ সুনাম রয়েছে। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এই সুনামের আড়ালে চাপা পড়ে আছে তার একটি কদর্য রূপ। রাজশাহীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা বাণিজ্যের আরেক চেহারা দেখিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সদস্য অধ্যাপক আবদুল খালেক। এ সুযোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর রাজশাহীতে বেসরকারি নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে দুই হাতে অর্থ কামিয়েছেন। স্ত্রীকে প্রতিষ্ঠাতা বানিয়ে প্রথমে টানা দুই মেয়াদে নিজে এর উপচার্য হয়েছেন। বিশ^বিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড ও সিন্ডিকেটের সদস্যসহ বিভিন্ন পদে ছেলেমেয়ে, জামাতা ও অনুগত লোকদের বসিয়েছেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপদেষ্টা পদের নামে বসে বসে লাখ টাকার বেতন তুলে নিচ্ছেন। এমন কী বাসার কাজের মেয়ে, গাড়িচালকের বেতনও দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) আমাদের সময় পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন জিয়াউল গনি সেলিম।

প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল খালেক প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে অবসর গ্রহণের পর ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠা করেন নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। যদিও কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠাতা তার স্ত্রী রাশেদা খালেক। এই ইউনিভার্সিটি পরিচালনা করেছেন তার পরিবারের সদস্যরাই। ট্রাস্টি বোর্ড থেকে সিন্ডিকেট এমন কী ইউনিভার্সিটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় পরিবারের সদস্য ও বেছে বেছে ঘনিষ্ঠদের বসিয়েছেন তিনি। ফলে প্রাইভেট এই ইউনিভার্সিটি খালেকের পারিবারিক ইউনিভার্সিটিতে রূপ নিয়েছে। যেখানে খালেকের কথাই শেষ কথা। এখন ৮৭ বছর বয়সে হয়েছেন ইউনিভার্সটির একমাত্র উপদেষ্টা। নিজের এই ইউনিভার্সিটি থেকে প্রতি মাসে বেতন তোলেন লাখ টাকার ওপরে। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জমি কেনা নিয়ে জালিয়াতি, শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা না দেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। গত ১০ বছরে প্রতিষ্ঠানটি থেকে তিনি নানা অজুহাতে অর্ধশত কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন।

অধ্যাপক আবদুল খালেক দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন সভা-সেমিনারে গর্ব করে নিজেকে ‘শেখ হাসিনার উপদেষ্টা’ হিসেবে পরিচয় দেন। ছিলেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের সদস্য। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য হওয়ায় বেসরকারি ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠায় বেগ পেতে হয়নি তাকে।

আবদুল খালেক নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য হিসেবে মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে বেতন নিতেন। দুই দফায় ৮ বছর উপাচার্য ছিলেন। এখন তিনি ইউনিভার্সিটির উপদেষ্টা। তবে দুই বছর ধরে উপাচার্য না থাকলেও তিনি সেই বেতন নিচ্ছেন। উপাচার্যের জন্য প্রায় কোটি টাকা দামের গাড়িটিও রেখেছেন নিজের দখলে। বাড়ির কাজের মেয়ে ও গাড়ির চালকের বেতন-ভাতা নেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে সুইপার, পিয়ন ও মালি থাকলেও তারা কাজ করেন আবদুল খালেকের বাড়িতে। অধ্যাপক খালেক নিজে উপদেষ্টা পদে নিয়মিত বেতন-ভাতা নেওয়ার পাশাপাশি তার স্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান রাশেদা খালেক, অর্থ উপদেষ্টা ছেলে ফয়সাল খালিদ শুভ এনবিআইইউ’র তহবিল থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। জামাই রিয়াজ মোহাম্মদকে রেজিস্ট্রার থেকে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী করা হয়েছে। তিনিও বেতন নেন লাখ টাকার বেশি।

অভিযোগ রয়েছে, রাজশাহী মহানগরীর বিনোদপুর বাজার এলাকার ৪৩ নম্বর বাসাটি ইউনিভার্সিটির অফিস দেখিয়ে মাসে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া নেন। যদিও সেটি ক্ষণিকা ছাত্রাবাস নামেই পরিচিত। ক্ষণিকার ঠিকানা ব্যবহার করেই ইউজিসি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নেন। এখানে আবদুল খালেকের বসবাসের বাড়িও। গত ১০ বছর ধরেই এভাবে ভাড়া নিচ্ছেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির কো-চেয়ারম্যান আবদুল খালেকের মেয়ে অধ্যাপক ফারজানা নিক্কণ। তিনি নিজের গাড়ি ভাড়া দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়কে। এ জন্য মাসে তিনি নেন ৫০ হাজার টাকা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে থাকা প্রতিষ্ঠানটির ৩ কোটি টাকার এফডিআর থেকে লভ্যাংশের টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগও আছে আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি ফরমের টাকা সাধারণ তহবিলে জমা না দিয়ে দীর্ঘ সময় নিজের কাছে রাখতেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটির তহবিল থেকে টাকা নিয়ে স্ত্রী অধ্যাপক রাশেদা খালেকের নামে তিন কাঠা জমি কেনেন অধ্যাপক খালেক। সেই জমি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে লিখে দেওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত সেটি করেননি। নগরীর অদূরে চৌদ্দপাই এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস। মূল সড়ক থেকে সেই ক্যাম্পাসে যেতে রাস্তার জন্য জমি কেনা হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। জনৈক আরেজান বেগমের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় দশমিক ০১৫৮ একর জায়গা কিনলেও রেজিস্ট্রেশন করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা মাজেদুল ইসলাম রাতুলের নামে। পরে রাতুলের কাছ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার জমি ১৫ লাখ টাকায় কেনা দেখান আবদুল খালেক। এই রাতুল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে একই সঙ্গে চাকরি করছেন।

এসব অনিয়ম ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক বিধান চন্দ্র দাস বলেন, অধ্যাপক আবদুল খালেক উপাচার্য থাকাকালীন যে টাকা বেতন নিতেন, উপদেষ্টা হওয়ার পর সেটি কমিয়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করা হয়। তবে ইউনিভার্সিটির গাড়ি ব্যবহার ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি উপাচার্য বিধান চন্দ্র।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ৯ সদস্যের মধ্যে পাঁচজনই আবদুল খালেকের পরিবারের। তার সন্তানরা সবাই ট্রাস্টি বোর্ডে আছেন। এর মধ্যে অধ্যাপক আবদুল খালেকের স্ত্রী রাশেদা খালেক ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং কো-চেয়ারম্যান মেজো মেয়ে ফারজানা নিক্কণ। সদস্য হিসেবে আছেন বড় মেয়ে ফারহানা শাওন, ছোট মেয়ে ফারাহ দীনা গুঞ্জন এবং একমাত্র ছেলে ফয়সাল খালিদ।

ট্রাস্ট্রি বোর্ডের আরেক সদস্য অধ্যাপক নুরুল্লাহ খালেক পরিবারের ঘনিষ্ঠ ও বন্ধু। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক খালেক সাহেবরা কোটি কোটি টাকা ফাইন্যান্স করেছেন। এ কারণে পরিবারের লোকজন ও বিশ্বস্তদেরই ট্রাস্টি করেছেন, যাতে সবকিছু নিজেদের কন্ট্রোলে থাকে। এখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটেনি।

অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটকেও পারিবারিকীকরণ করেছেন অধ্যাপক খালেক। ১১ সদস্যের সিন্ডিকেট সভার সবাই তার অনুগত ও ঘনিষ্ঠ। সিন্ডিকেটে আছেন আবদুল খালেক, তার স্ত্রী রাশেদা খালেক, মেয়ে ফারজানা নিক্কণ। এ ছাড়া বাকিরাও খালেক পরিবারের ঘনিষ্ঠ।

এসব বিষয়ে অধ্যাপক আবদুল খালেক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যা করা হয়েছে সেগুলো আইন মেনেই করা হয়েছে। প্রযোজ্যক্ষেত্রে ইউজিসির অনুমোদনও রয়েছে। আর ট্রাস্টি বোর্ডের আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা বিনিয়োগকারী হিসেবে রয়েছে। জমিও কেনা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামেই। কোনো ক্ষেত্রেই অনিয়ম হয়নি।’

অধ্যাপক আবদুল খালেকের পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক ড. সুলতান মাহমুদ ভূঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পারিবারিক ট্রাস্টি বোর্ড বা সিন্ডিকেট গঠনের ক্ষেত্রে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এ সুযোগটাই নিচ্ছেন অনেকে। আমরা এখন এসব বিষয়ে নতুন করে প্রচুর অভিযোগ পাচ্ছি। এটা নিয়ে আমরা আলাপও করেছি। এ ধরনের কাজ নৈতিকতার দিক থেকে খুবই অস্বস্তিকর। সব মিলিয়ে আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আমাদের কথা হচ্ছে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.007004976272583