কেন্দ্রীয় ব্যাংক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা, স্থান, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে কিছু প্রতীকী নোট বা মুদ্রা অবমুক্ত করে। এগুলো স্মারক নোট বা মুদ্রা হিসেবে অভিহিত। স্মারক নোটেও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের স্বাক্ষর থাকে। সাধারণ ব্যাংক নোটে ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’, লেখা থাকলেও স্মারক নোটে থাকে ‘বিনিময় যোগ্য নয়’।
উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নিয়েও ৫০ টাকার স্মারক নোট বের করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ২৮ অক্টোবর কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মাণ করা এ প্রকল্পের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ স্মারক নোট অবমুক্ত করবেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। উদ্বোধনের পরদিন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল ও চট্টগ্রাম অফিস এবং পরে অন্যান্য শাখা অফিস ও ঢাকা জাদুঘর থেকে তা কেনা যাবে। খামসহ স্মারক নোটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ টাকা এবং বাংলা ও ইংরেজি লেখা খামসহ ফোল্ডারের দাম একশত টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের স্বাক্ষরে মুদ্রিত এ স্মারক নোটের সামনের বামপাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি এবং ডানপাশে টানেলের সম্মুখ অংশের ছবি দেয়া হয়েছে। নোটের পেছনভাগে টানেলের ভেতরের অংশের আরেকটি ছবি দেয়া হয়েছে। নোটের সামনের শিরোনাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল/সংযোগে নতুন সম্ভাবনা’।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট স্মারক নোট বা মুদ্রা প্রকাশ করে থাকে। প্রচলিত ব্যাংক নোটের মান যেখানে ১০০, ২০০, ৫০০, ১০০০ প্রভৃতি সেখানে স্মারক নোট বা মুদ্রার মান ১০, ২৫, ৪০, ৬০, ৭০ প্রভৃতি। বাজারে প্রচলিত মুদ্রা থেকে স্মারক মুদ্রা বা নোটকে আলাদা করতে সাধারণত এর মান অনিয়মিত রাখা হয়। তবে কখনো কখনো প্রচলিত মানের নোটও ছাপা হয়ে থাকে। যেমন- ১০, ২০, ৫০, ১০০ প্রভৃতি।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম স্মারক মুদ্রা অবমুক্ত করে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে। বিজয়ের ২০তম জয়ন্তী উপলক্ষে ১ টাকার রুপার মুদ্রা অবমুক্ত করা হয়। এটি ছিল ১ টাকার (ফাইন সিলভার) কয়েন। পরের বছর ৯২ খ্রিষ্টাব্দে অলিম্পিক গেমসের ২৫তম আসর উপলক্ষে একই মানের রুপার মুদ্রা অবমুক্ত করা হয়েছিল।
এরপরে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে আলাদা আলাদা স্মারক মুদ্রা ১০ টাকার (ফাইন সিলভার) কয়েন প্রকাশ করা হয়। ১৯৯৮ সারে বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ১০ ও ২০ টাকা মূল্যের স্মারক মুদ্রা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রথমটি ছিল একশ শতাংশ নিকেলের। পরেরটি ৯০ শতাংশ ফাইন সিলভার এবং ১০ শতাংশ নিকেলের।
২০০০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম ২২ ক্যারেট স্বর্ণের স্মারক মুদ্রা অবমুক্ত করে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ২০ টাকার মুদ্রা প্রকাশ করা হয়। এরপর প্রায় এক দশক বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো স্মারক নোট বা মুদ্রা প্রকাশ করেনি। ২০১১ তে মোট ৫টি স্মারক নোট বা মুদ্রা প্রকাশ করা হয়। আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মজয়ন্তী এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের ৯০তম বছর উপলক্ষে ১০ টাকা মূল্যের (ফাইন সিলভার) আলাদা আলাদা মুদ্রা প্রকাশ করা হয়। বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৪০ টাকার (ফাইন সিলভার) মুদ্রা এবং ৪০ টাকার কাগুজে নোট প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পরের বছর ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৬০ টাকার নোট প্রকাশিত হয়। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড-এর ২৫ বছর এবং জাতীয় জাদুঘরের শত বছর পূর্তি উপলক্ষে ২৫ ও ১০০ টাকা মূল্যের স্মারক নোট প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়া উপলক্ষে ৭০ টাকার নোট এবং ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে জাতির পিতার শততম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে ১০০ টাকার নোট প্রকাশ করা হয়। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ৫০ টাকার নোট এবং ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে ১০০ টাকার স্মারক নোট প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন উপলক্ষে ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন ৫০ টাকার স্মারক নোট অবমুক্ত করবেন।
স্মারক নোট বা মুদ্রার অভিহিত মূল্য এবং বাজারমূল্য কিন্তু সব সময় এক নয়। ১০ টাকা মূল্যের ফাইন সিলভার কয়েনগুলো সাধারণ ৩৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। সোনার কয়েনগুলোর বিক্রয়মূল্য বাজারে সোনার দামের সঙ্গে ওঠানামা করে। স্মারক নোট ফোল্ডার হিসেবে বিক্রি হলে খানিকটা বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখার ক্যাশ বিভাগের নির্দিষ্ট কাউন্টারসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে স্মারক নোট বা মুদ্রা নগদ অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এর টাকা জাদুঘর পরিদর্শনে আসা অতিথিদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে স্মারক নোট বা মুদ্রা উপহার দেয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন মুদ্রা জাদুঘরে বাংলাদেশের স্মারক নোট ও মুদ্রা প্রদর্শিত হয়।
সব স্মারক নোট ও মুদ্রা অবিনিময়যোগ্য। তাই এগুলোর স্থান শুধু শৌখিন সংগ্রাহকের সংগ্রহশালায়।