বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি স্থাপনে খরচ হবে ১০ হাজার কোটি টাকা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে দেশে এ যাবৎ সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছে নেত্রকোনার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। মূলত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ২০০ একর হওয়ায় এত টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় মাত্র ৫০ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি স্থাপনের ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকার ব্যয় দেখিয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজাল (ডিপিপি) জমা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। বাকি টাকার বেশিরভাগই খরচ হবে কেনাকাটায়। এই অবকাঠামো নির্মাণ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থী পড়তে পারবেন। বুধবার (২৫ মে) দেশ রূপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির ব্যয় প্রথম পর্যায়ে কোনোভাবেই এক হাজার কোটি টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। তবে ধাপে ধাপে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে আরও কিছু ব্যয় বাড়তে পারে।

ডিপিপি মূল্যায়ন কমিটির প্রধান ইউজিসির সদস্য অধ্যাক ড. মুহাম্মদ আলমগীর  বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ডিপিপি সংশোধন করতে বলেছিলাম। কিন্তু তারা তেমনভাবে কোনো পরিবর্তন করেননি। পরে আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণসহ সেই ডিপিপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি।’

ইউজিসি সূত্র জানায়, গত বছরের জুন মাসে ১০ হাজার ৪৫১ কোটি টাকার ডিপিপি ইউজিসিতে জমা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় জুন-২০২২ থেকে জুন-২০২৫ পর্যন্ত। কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীরের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি ডিপিপি মূল্যায়ন করে।

সেখানে তারা প্রথম পর্যায়ে একাডেমিক প্ল্যান অনুযায়ী জরুরি ভৌতকাঠামো, আসবাব এবং জরুরি কিছু ইকুইপমেন্ট নিয়ে নতুন করে ডিপিপি প্রণয়নের অনুরোধ করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডিপিপির সামান্য পরিবর্তন করে ৪০০ কোটি টাকা কমিয়ে ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকা প্রস্তাব করে। আর সেই ডিপিপি গত মার্চে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে অনেকটাই বাধ্য হয় ইউজিসি। যদিও এই ডিপিপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর পরিকল্পনা কমিশনে যাবে। এরপর চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।

ইউজিসিতে জমা দেওয়া ডিপিপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রকল্প কার্যক্রমের জন্য মোট ক্রয় পরিকল্পনা-পণ্যের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ৫ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন ল্যাব ১৬৯ কোটি টাকা, যানবাহন ২১ কোটি, গবেষণা যন্ত্রপাতি ৭৪৩ কোটি, অফিস ইকুইপমেন্ট ৩৯ কোটি, আসবাব ৭২ কোটি, সুপার কম্পিউটার ৭৮৭ কোটি, আইসিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর স্মার্ট ক্যাম্পাস ৩৬১ কোটি, আইসিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর টিচিং লার্নিং ২ হাজার ১২৫ কোটি, সার্ভিস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স ৮৪৬ কোটি, আরবরিকালচার, গার্ডেনিং ও সৌন্দর্যবর্ধন ৭৬ কোটি এবং লাইব্রেরির বইপত্র কেনার জন্য ১০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।  পূর্তকাজের মধ্যে  চারতলা মসজিদ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ কোটি, সুইমিং পুল ২৩ কোটি, পাঁচতলা দুটি বক্তৃতা মঞ্চ ১০৬ কোটি, দোতলা স্কলার প্লাজা ৭১ কোটি, দুটি ওয়াকিং ও ড্রাইভওয়ে ১৩ কোটি, আটতলা সুপার কম্পিউটিং ৭৯ কোটি, সাততলা ইনকিউবেশন সেন্টার ৭১ কোটি, আনুষঙ্গিকসহ ছয়তলা লাইব্রেরি ৪০ কোটি, সাততলা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ২০০ কোটি, ছয়তলা স্পোর্টস কমপ্লেক্স ৬৬ কোটি ও শহীদ মিনার নির্মাণে সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি ফটক নির্মাণ করা হবে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ কোটি টাকা। 

আনুষঙ্গিকসহ দোতলা উপাচার্য বাংলো নির্মাণে সাড়ে ৫ কোটি, দোতলা সহকারী উপাচার্য বাংলো প্রায় ৫ কোটি, দোতলা কোষাধ্যক্ষ বাংলো প্রায় ৫ কোটি, চারতলা অতিথি ভবন সাড়ে ৫ কোটি, তিনটি সিকিউরিটি ব্যারাক ১৫ কোটি, মেডিকেল সেন্টার ১২ কোটি, চারতলা টিচার্স ক্লাব ১৩ কোটি, ফুটবল-ক্রিকেট গ্রাউন্ড ৭৯ কোটি, ৮ লেন ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইভেন্টস ৮০ কোটি, পাঁচটি ব্রিজ ৫৬ কোটি, বাউন্ডারি ওয়াল ২০০ কোটি, এক্সটারনাল ইলেকট্রিক লাইন ১৬ কোটি, এক্সটারনাল ওয়াটার লাইন ২২ কোটি, ইন্টারনাল রোড ৯ কোটি, সারফেস ড্রেন ২২ কোটি ও ময়লা-আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

এ ছাড়া একাডেমিক ভবন ও ছাত্র-ছাত্রী হল নির্মাণেও অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হয়েছে। আনুষঙ্গিকসহ দুই হাজার ছাত্র ও দুই হাজার ছাত্রীর জন্য ১১তলা চারটি হল তৈরির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০৩ কোটি টাকা, ১২০ জন জুনিয়র শিক্ষকের জন্য ১৬তলা একটি ভবন ১৬৬ কোটি, ২৪০ জন সিনিয়র শিক্ষকের জন্য ১৬তলা দুটি ভবন ২৮০ কোটি, ৩৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ২১তলা তিনটি ভবন ৩৫৪ কোটি, আনুষঙ্গিকসহ ২১তলা চারটি অনুষদ ভবন ১ হাজার ৬০ কোটি ও ১১তলা একটি প্রশাসনিক ভবন নির্মাণে ১৭১ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

ডিপিপি মূল্যায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইউজিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, তারা ধর্ম মন্ত্রণালয়ে খবর নিয়েছেন। তারা পাঁচতলা মডেল মসজিদ নির্মাণ করে। যেখানে লাইব্রেরি, সেমিনার কক্ষসহ সব মিলিয়ে ব্যয় হয় ছয় কোটি টাকা। অথচ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ কোটি টাকা। এ বিষয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করলে তারা একই ব্যয় রেখেই মসজিদের সঙ্গে একটি মন্দির যুক্ত করে দেয়।

ইউজিসির ওই কর্মকর্তা বলেন, সুপার কম্পিউটার এখনো দেশে নেই। তারা জানতে পেরেছেন যে এ ধরনের কম্পিউটার নাসাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া সুইমিং পুল, বক্তৃতা মঞ্চ, স্কলার প্লাজা, স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণের কী দরকার তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বোঝাতে পারেনি। এ ছাড়া ফুটবল বা ক্রিকেট মাঠের জন্য ৭৯ কোটি টাকা, আট লেন ট্র্যাকের জন্য ৮০ কোটি কেন ব্যয় করতে হবে। এটা তো স্পোর্টস বিশ্ববিদ্যালয় নয়।

ডিপিপি মূল্যায়ন কমিটির আরেকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নে ৩৮ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এটা ঠিক আছে। তবে নির্মাণ ব্যয়সহ অন্যান্য কাজের ব্যয়ের ব্যাপারে তারা একমত হতে পারেননি। প্রথম পর্যায়ে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে ব্যয় কোনোভাবেই এক হাজার কোটি টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।

ইউজিসির ওই কর্মকর্তা বলেন, ডিপিপি সংশোধনের জন্য তারা বারবার বলেছেন। কিন্তু বিশ্বদ্যিালয় কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো পরিবর্তন না করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর বলেন, ‘ইউজিসি ডিপিপির যেসব সংশোধন দিয়েছিল, তা আমরা করে দিয়েছি। এরপর তারাই তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তবে এটাই তো ফাইনাল না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর প্রি-একনেক, একনেক শেষে তা পাস হবে।’ মসজিদ, সুইমিং পুল, স্পোর্টস কমপ্লেক্সসহ নানা ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ব্যয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করেছে। আমি আর কোনো মন্তব্য করব না।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) ড. মো. আমজাদ হোসেনের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির ডিপিপির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের জন্য ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই জাতীয় সংসদে আইন প্রণীত হয়। ২০১৮ সালের ১২ জুন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূরকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পদে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। আগামী ১১ জুন অধ্যাপক নূরের মেয়াদ শেষ হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029449462890625