বঙ্গবন্ধু থাকলে অনেক আগেই শিক্ষা জাতীয়করণ হতো

মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ |
স্বাধীনতা অর্জনের পরই স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার হাজার  প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে অনেক আগেই বেসরকারি শিক্ষকদেরও ‘শিক্ষা জাতীয়করণের’ স্বপ্নপূরণ হতো। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানের ১৭ (ক) ধারায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন অবৈতনিক শিক্ষার কথা উল্লেখ থাকলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৭৩-এর ২০ মার্চ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু স্নাতকধারীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দুই শ’ বছর ও পাকিস্তানের ২৫ বছরে গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থা শুধু কেরানি তৈরি করেছে, মানুষ তৈরি করেনি। এজন্য বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থায় আদর্শ, দক্ষ নাগরিক গড়ে তোলার বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব দেন।
 
বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশে কোনোরকম খনিজদ্রব্য সোনা-দানা, হীরা-মুক্তা, তেল সম্পদ বলতে কিছুই নেই, তা সত্ত্বেও বাংলাদেশটিকে আপনি বারবার সোনার বাংলা বলে চিহ্নিত করছেন কেনো? সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-  ‘আমার বাংলার মাটি আছে, আমার বাংলার মানুষ আছে। আমি বাংলার মাটি এবং মানুষকেই সোনা বলে মনে করি। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। খনিজ সম্পদের চেয়েও বড় সম্পদ। এই মানবসম্পদই একদিন বাংলাদেশকে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যাবে’।
 
বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে সবসময় সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়াররূপে দেখতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি করা সম্ভব নয়। তার ভাষায়- ‘শিক্ষা হচ্ছে বড় অস্ত্র যা যেকোনো দেশকে বদলে দিতে পারে’। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলতেন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরের মতো প্রাকৃতিক সম্পদবিহীন দেশ শুধু মানবসম্পদ সৃষ্টি করে যদি উন্নত দেশ হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশও একদিন উন্নত দেশ হবে। 
 
অর্জন-অতৃপ্তির ঘূর্ণাবর্তে শিক্ষা জাতীয়করণ এখন এক কল্পনাবিলাস মাত্র। অনেকে মনে করেন, নির্বাচনের বছরে সরকারকে বিব্রত করা বা চাপে ফেলার জন্য শিক্ষা জাতীয়করণের চলমান তৎপরতা। কথাগুলো নিতান্তই খণ্ডিত ভাবনা। শিক্ষা জাতীয়করণের চাওয়া মূলত কয়েকটি কারণে: 
 
(১) পেশাগত চরম বঞ্চনা। একজন সাধারণ শিক্ষকের সামর্থ্য এখন এমন যে, কেউ আর তাদেরকে দৈনন্দিন ধার-কর্জও দিতে চায় না।
(২) খণ্ডিত জাতীয়করণের তৎপরতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান বাদ যাওয়া। 
মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ

 

 
এমন আরো অনেক কারণে এমপিওভুক্তদের মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবুও মানুষ গড়ার নিপুণ-নীবর এসব কারিগরদের আকাঙ্ক্ষা অবদমিত হয়নি। কারণ, আমরা জানি, যুগে যুগে কোনোদিনই মানুষের অধিকারের আওয়াজ হারিয়ে যায়নি। শিক্ষা জাতীয়করণের আওয়াজও ক্ষীণ হলেও শেষ হয়ে যাবে না। বরং জাতীয় প্রয়োজনে বারবার তা ফিরে ফিরে আসবে।
 
আশা ও আশ্বাসবাণীর মধ্য দিয়ে শিক্ষা জাতীয়করণের ফিকে হয়ে যাওয়া সম্ভবনা টিকে রইলো। আশা করি, শিক্ষা জাতীয়করণে গঠিত কমিটির সুপারিশ ও নীতিমালার আলোকে আগামীতে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। 
 
জিজ্ঞাসা থাকতে পারে কেনো বার বার এমপিওভুক্ত নিরীহ বেসরকারি শিক্ষকরা খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন, কেনো তাদের আহাজারি আকাশের অসীম শূন্যতায় মিলিয়ে যায়? তবে আত্ম-বিশ্লেষণ থেকে বলতেই হয়:
* সর্বস্তরের এমপিওভুক্তদের নেতৃত্বে ঐক্যের অভাব
* সর্বাত্মক অনড় অবস্থান ও পারস্পরিক যোগাযোগের অভাব
* ঘোষিত কর্মসূচিতে সবার অংশগ্রহণ না থাকা।
* অতি আশাবাদী প্রবণতা
* বিভিন্ন পেশাজীবী ও সামাজিক শক্তির সমর্থন আদায়ে ব্যর্থতা
* সঠিক নেতৃত্ব ও আন্তঃসাংগঠনিক সমন্বয়হীনতা
 
এ সবকিছুর পরও আমি আমার তিন দশকের পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, যা হয়েছে ও যতোটুকু হয়েছে তাই আমাদের অর্জন ও প্রেরণা।
সত্য বলতে কী, পেশাগত দাবি আদায়ে আমাদের নেতৃত্বের অনৈক্য খুবই স্পষ্ট এবং আশ্চর্যজনক বাস্তবতায় এর কারণও যথার্থ। তা হলো:
 
• জাতীয় রাজনীতির ধারায় শিক্ষক সংগঠনগুলো দলীয় পরিচয়ে ও স্বার্থে ব্যবহৃত
• শিক্ষক নেতারা ‘শিক্ষক পরিচিতি’র আড়ালে নির্বাচনের বছরে নিজেদেরকে নতুনভাবে মেলে ধরতে তৎপর 
• শিক্ষক সংগঠনগুলোর পরস্পর বিরোধী দারুণ অভিনব কর্মসূচি
 
আমি তবুও প্রত্যাশার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। একটি হিসেবে দেখা যায়, যদি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতনের পুরো অংশ সরকারি কোষাগারে জমা নিয়ে শিক্ষার পুরো দায়িত্ব সরকার নিতো তাহলে সরকারের লাভ বেশি হতো। এমনিতেই বেসরকারি শিক্ষকরা বর্তমানে বেতন স্কেলের শতভাগ, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া আছে বাড়িভাড়া আর সামান্য মেডিক্যাল ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা।
 
আমরা বেসরকারি শিক্ষকরা বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পর জাতীয়করণের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি। জাতীয়করণ হলে শিক্ষকরা লাভবান হবে না, লাভবান হবে। তারা তাদের দোরগোড়ায় পছন্দের সরকারি স্কুল-কলেজ পাবে সঙ্গে তাদের আর্থিক সাশ্রয়ও হবে। শিক্ষার্থীদের থেকে আদায়কৃত অর্থসহ প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিয়ে শিক্ষার পুরো দায়িত্ব সরকার নিলে এটাই হবে জাতীয়করণের সহজ সূত্র।
 
পাঁচ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের পরিবার ‘মাদার অব হিউমিনিটি’ প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের অধিকারের আওয়াজ যেন অনন্ত অপেক্ষা ও আক্ষেপে হারিয়ে না যায়। বরং এমপিওভুক্তদের সব বঞ্চনার অবসানে শিক্ষক দরদি প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণা বাংলাদেশের প্রায় ১০০ ভাগ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর মুখে হাসি ও বুকে সাহস জোগাবে।
 
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর 

 

 

 

 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল   SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের - dainik shiksha ‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক - dainik shiksha পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন - dainik shiksha প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002310037612915