পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিলো ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভোরে। মানবিকতা সেদিন ভূলুণ্ঠিত হয়েছিলো। শিশু ও নারী হত্যার নৃশংসতা সেদিন বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিলো। বিশ্ব স্তম্ভিত হয়েছিলো। জাতি শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলো। দশ বছরের ছোট্ট শিশু রাসেল রাজনীতির কিছুই বুঝত না। কিন্তু ঘাতকদের এতোটুকু মায়া হয়নি এই নিষ্পাপ শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে। রাসেল বাঁচতে চেয়েছিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলো।’ ঘাতকরা বলেছিলো, ‘চল তোকে তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।’ সরল প্রাণ ছোট্ট রাসেল ওদের কথা বিশ্বাস করেছিলেন। মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ঘাতকরা তার বুকে গুলি চালিয়েছিলো। এ কেমন নির্মমতা! নীরিহ নারীরাও সেদিন ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পাননি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এতো বড় একটি হত্যাকাণ্ড নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করলেন মাঝারি পর্যায়ের গুটি কয়েক সেনা অফিসার!
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সেনাবাহিনীর অভ্যান্তরে একটা ষড়যন্ত্র চলছে এ খবর বিদেশি গোয়েন্দারা বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলো। কিন্তু বাঙালি সেনারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেন, এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি। বাঙালির প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসাই তার জন্য কাল হয়েছিলো। তার বিশ্বাস ছিলো, যেখানে পাকিস্তানিরা তাকে মারতে সাহস করেনি সেখানে তার সন্তানতুল্য বাঙালি সেনারা তাকে মারতে সাহস দেখাবে না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যান্ত সাহসী ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী। ঘাতকদের উদ্যত স্টেনগানের সামনে দাঁড়িয়েও তিনি হুংকার ছেড়ে বলেছিলেন, ‘কি চাস তোরা?’
বঙ্গবন্ধু পালানোর চেষ্টা করতে পারতেন। কিন্তু পালানোর মনোবৃত্তি কোনোদিনই তার ছিলো না। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতেও তিনি বাঙালি জাতিকে অসহায় রেখে পালিয়ে যাননি। তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা তাকে সেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মনে করতেন নেতা কখনো পালাতে পারেন না। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভোরেও তিনি একই কাজ করেছিলেন। বাড়ি আক্রান্ত হলে তিনি তখনকার সেনা প্রধান মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ বীর উত্তমকে ফোন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট?’ অর্থাৎ সফিউল্লাহ সেদিন বঙ্গবন্ধুকে যেকোনোভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার পুরো পরিবারকে অসহায় রেখে নিজে বের হওয়ার চেষ্টা করেননি। এই হলো বঙ্গবন্ধু। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি অবিচল, সাহসের মূর্ত প্রতীক।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোরটি অন্য পাঁচটা ভোরের মতো স্বাভাবিক হতে পারতো। কিন্তু সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাসী সেনা তা হতে দেননি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগদানের কথা ছিলো। কিন্তু ঘাতকরা পূর্বের দিন তাদের পরিকল্পনায় শান দিচ্ছিলেন। ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে যখন কর্নেল ফারুকের নির্দেশে ট্যাঙ্ক ও কামানগুলো পরিকল্পনামতো নির্দিষ্ট অবস্থানে জড়ো করা হচ্ছিলো এবং মধ্যরাতে সেগুলো যখন রাস্তায় নামলো তখন কারো মনেই কি কোনো সন্দেহ হয়নি? সেনাবাহিনীর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর অনুগত, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র অফিসাররা কি কিছুই আঁচ করতে পারেননি? এতো বড় একটা পরিকল্পনা হলো অথচ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারা কি কিছুই বুঝতে পারেননি?
বিদ্রোহীরা সংখ্যায় খুব বেশি ছিলো না। বিপরীতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, রক্ষিবাহিনী, দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী সমর্থক মিলিয়ে এক বিশাল শক্তি। অথচ কোনো পক্ষ থেকেই প্রতিরোধের চেষ্টা পর্যন্ত করা হলো না! এটা ভাবলে বিষ্মিত হতে হয়। বাঙালির সান্ত্বনা এই টুকু শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান। তারপরের ইতিহাস সকলের জানা। অন্ধ ক্ষমতালোভী অবৈধ স্বৈরশাসকেরা পবিত্র সংবিধান ভূলুণ্ঠিত করে গণতন্ত্রের কবর রচনা করে। সংবিধানে ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ পাস করে খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে। হত্যাকারীদের বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর স্টিম রোলার চালায়। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের পুর্নবাসন করে। পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে নব প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস জানা থেকে দূরে রাখে। দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা এবং মেধাবী সৈনিকদের হত্যা করে। এমনই এক বিভীষিকাময় অরাজক অবস্থার মধ্যে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মে বাঙালি জাতির শেষ আশার আলো শেখ হাসিনা দেশে ফিরে দলের হাল ধরেন। তার প্রজ্ঞা, ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। সেদিন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিলো বলেই আমরা ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের খুনিদের বিচার প্রত্যক্ষ করি। খুনিদের ফাঁসির মাধ্যমে একদিকে যেমন সত্যের জয় হয়, অন্যদিকে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন পর দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে। কিন্তু এটাও সত্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশকে কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে দেয়া হয়। ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে যে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশের স্বপ্ন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দেখাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তা আরো আগেই আমরা দেখতে পেতাম। বঙ্গবন্ধু যে সব কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন সেগুলো বাস্তবায়িত হলে শোষণহীন, শ্রেণি বৈষম্যহীন উন্নত সমৃদ্ধশালী একটা দেশের জন্য আমাদের এতোদিন প্রতিক্ষা করতে হতো না।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঘাতকরা তার নাম মানুষের হৃদয় থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নাম কোটি কোটি বঙালির হৃদয়ে সদা জাগ্রত। যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে ততোদিন বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার শক্তি কারো নেই। সংগীতে, সাহিত্যে, চিত্রকলায়, গবেগষণায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি চিরকালীন।
লেখক : সন্তোষ দাস, প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি কলেজ, ফকিরহাট, বাগেরহাট
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।