বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভা*ঙচুর: রিমান্ডে দুই মাদরাসা ছাত্রকে নি*র্যাতনের অভিযোগ

দৈনিক শিক্ষাডটকম, কুষ্টিয়া |

কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের অভিযোগে গ্রেফতার দুই শিশুর ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে দুইদিন পুলিশ লাইনে আটক রেখে এবং রিমান্ডে নিয়ে পাঁচদিন অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় দুই শিশুর ওপর। নির্যাতনের একপর্যায়ে শিশু আবু বক্কর মিঠুন অজ্ঞান হয়ে যায়। আর নির্যাতনের কারণে উঠে দাঁড়াতে পারত না আরেক শিশু সবুজ ইসলাম নাহিদ। দেড় বছর কারাগারে অসুস্থ ছিল সে। শুধু পুলিশি নির্যাতন নয়, নিু ও উচ্চ আদালতেও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত তারা। দুই আদালতে ২৪ বার শুনানি করেও জামিন মেলেনি তাদের। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে তিন বছর আট মাস পর ৭ অক্টোবর তাদের খালাস দেন আদালত। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দুই শিশুকে নিয়ে যা হয়েছে, তা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ বলেছে, রিমান্ডে কোনো আসামিকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হয়নি।

 

কুষ্টিয়ায় শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটি ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর রাতে ভাঙচুর করে দুষ্কৃতকারীরা। এ ঘটনায় দেশজুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। গ্রেফতার হয় মাদরাসার দুই শিক্ষক ও দুই শিক্ষার্থী। তৎকালীন কুষ্টিয়া পৌরসভার সচিব কামাল উদ্দীনের করা মামলায় গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন কুষ্টিয়া শহরের জগতি পশ্চিমপাড়া এলাকার ইবনি মাসউদ (রা.) মাদরাসার শিক্ষক ইউসুফ আলী ও আল আমিন এবং একই মাদরাসার ছাত্র মিঠুন ও নাহিদ।

আসামিপক্ষের আইনজীবী কাজী তুহিন বলেন, গ্রেফতারের সময় মাদ্রসাছাত্র মিঠুনের বয়স ছিল ১৫ বছর ৮ মাস। আর নাহিদের ১৬ বছর। ওই সময় তারা শিশু ছিল। বিষয়টি আমরা বারবার আদালতের নজরে এনেছি। কিন্তু আদালত আমাদের কথা গ্রহণ করেননি।

মাদরাসাছাত্র মিঠুন বলে, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর পুলিশ আমাকে বাসা থেকে তুলে পুলিশ লাইনে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে দুইদিন আটকে রেখে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়। তাৎকালীন এসপি তানভীর আরাফাত নিজে আমার হাত পেছনের দিকে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে মুখে প্রচণ্ড আঘাত করতে থাকে। আমার সারা মুখ রক্তে ভেসে যায়। একপর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। এভাবে দুইদিন নির্যাতন করে আমাকে কারাগারে পাঠায়। এরপর ফের আমাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ডে আবার নির্যাতন চালানো হয়। নয় মাস আমাকে কারাগারের কনডেম সেলে রাখা হয়। কারাগারের মধ্যে আমি দেড় বছর অসুস্থ ছিলাম। পরে আমাকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

মিঠুন আরো বলে, আমার অসুস্থতার বিষয়টি বারবার জানালেও আদালত আমাদের কোনো কথা গ্রহণ করেননি। তিন বছরে কতবার জামিন ধরেছি, তার হিসাব নেই। উচ্চ আদালতেও আমাদের জামিন দেওয়া হয়নি। এমনকি পরিবারের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি।

মাদরাসাছাত্র নাহিদ বলে, কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে দুইদিন আটকে রেখে আমাদের লাঠি দিয়ে অনবরত পেটানো হয়। রিমান্ডে আমাকে আবারও এমনভাবে নির্যাতন করা হয়, আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। হাঁটাচলা সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাস আমাদের কনডেম সেলে রাখা হয়েছিল; যেখানে ফাঁসির আসামিরা থাকে। আমাদের জেলখানার ভেতরে চলাফেরা করতে দেওয়া হতো না। পরিবারের সঙ্গে কোনো কথা বলতে দেওয়া হয়নি। আমার পরিবার কুষ্টিয়া আদালতে অসংখ্যবার জামিনের আবেদন করেছে, এর কোনো হিসাব নেই। আমরা শিশু হওয়া সত্ত্বেও কুষ্টিয়া আদালত আমাদের একবারও জামিন দেননি। এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া জজকোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর খন্দকার সিরাজুল ইসলাম বলেন, জামিনের ক্ষেত্রে আইনে কিছু সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। সেক্ষেত্রে আসামি শিশু বা নাবালক হলে অবশ্যই জামিন পাওয়ার হকদার। রিমান্ডের ক্ষেত্রেও সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রয়েছে-আসামিদের শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে দেশে কোনো আইনের শাসন বা মানবাধিকার বলে কিছুই ছিল না। বিগত সরকারের রেষানলে পড়ে দুই শিশু ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

কুষ্টিয়া ফেয়ার এনজিওর পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী আক্তারুজ্জামান বলেন, তাদের তো জেলে থাকার কথা ছিল না। তাদের থাকার কথা ছিল শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে। দুই শিশু ও তাদের পরিবারের ওপর চরম অন্যায় করা হয়েছে। বর্তমানে সুবিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইচ্ছা করলে নির্যাতনের শিকার দুই শিশুর পরিবার মামলা করতে পারে।

জানতে চাইলে কুষ্টিয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) পলাশ কান্তি নাথ বলেন, ঘটনাটি ঘটেছিল ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে। সেসময় অন্য কর্মকর্তারা এখানে কর্মরত ছিলেন। তবে রিমান্ডে কোনো আসামিকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হয় না। অনেকেই মনে করেন রিমান্ড মানে নির্যাতন। রিমান্ডে মূলত আসামিদের নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। উল্লেখ্য, গ্রেফতার চারজনের মধ্যে দুই মাদরাসা শিক্ষক ইউসুফ আলী ও আল আমিনকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি অব্যাহতি দেন আদালত। আর মাদরাসাছাত্র মিঠুন ও নাহিদকে ৭ অক্টোবর খালাস দেন কুষ্টিয়া নারী ও শিশু আদালত।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
বর্তমানে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়ার কেউ নেই: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha বর্তমানে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়ার কেউ নেই: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শিক্ষাখাতের নতুন তদবিরবাজ তিতাস! - dainik shiksha শিক্ষাখাতের নতুন তদবিরবাজ তিতাস! শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা চলছে: সমন্বয়ক হান্নান - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা চলছে: সমন্বয়ক হান্নান তদন্ত রিপোর্ট না দিয়েই সটকে পড়ছেন শিক্ষা পরিদর্শকরা - dainik shiksha তদন্ত রিপোর্ট না দিয়েই সটকে পড়ছেন শিক্ষা পরিদর্শকরা বরখাস্ত হচ্ছেন শিক্ষা বোর্ডের সেই সচিব নারায়ণ নাথ - dainik shiksha বরখাস্ত হচ্ছেন শিক্ষা বোর্ডের সেই সচিব নারায়ণ নাথ আমরা চাই না ছাত্রদের কঠোর হয়ে দমন করতে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা - dainik shiksha আমরা চাই না ছাত্রদের কঠোর হয়ে দমন করতে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029821395874023