বঞ্চিতের পাঠাগার

নিজস্ব প্রতিবেদক |

১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর।  হিমেল শীতের সেই সন্ধ্যায় কয়েকজন তরুণ আড্ডার জায়গার খুঁজতে খুঁজতে এমন এক আড্ডাখানা বানিয়ে ফেলল যা গোটা এলাকার উন্নয়ন চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে অচিরেই। যশোর জেলা শহর থেকে পাকা ২৫ মাইল পশ্চিমে একেবারে ভারতীয় সীমান্ত লাগোয়া ছোট্ট এক হাটখোলায় স্থাপিত হয়ে গেল এক গণপাঠাগার। পাঠাগার বলতে শিক্ষিত মানুষের বিনোদন কেন্দ্র হবে, এমন সমালোচনা উঠল পয়লাই যখন এ প্রতিষ্ঠান গড়তে চাঁদা তুলতে জনা চারেক তরুণ হাটের আনাজমরিচের দোকানে হাত পাতল। দু আনা, চার আনা করে পয়সা তুলে তৈরি হবে এক গণপাঠাগার যেখানে অপেক্ষাকৃত ধনী লোকদের এড়িয়ে গেল উদ্যোগী সেই তরুণের দল। পারিবারিক  রাজিয়া লাইব্রেরি থেকে বেশ কিছু বই পাওয়া গেল দান হিসেবে। তাদের এক বয়োজ্যেষ্ঠ যুবক মহসিন আলি তার সদ্য তোলা ছোট্ট দোকানঘরে বসার জায়গা দিলেন, ব্যবস্য শিকেয় ঝুলিয়ে। সেখানে যখন বই নিয়ে আলোচনা, বইপড়া নিয়ে আড্ডা জমল ঠিক তখন এলেন জমিদারি উচ্ছেদ হলেও বিপুল জমির মালিক এক সাবেক নিরক্ষর জমিদার আকবর আলী সরদার। তিনি দশ কাঠা জমি দান করবেন। এ যেন মেঘ না চাইতেই বাদলদিনের আগমন।

এটা কোন গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। যশোর জেলার শার্শা থানার একেবারে উত্তর সীমান্তবর্তী গ্রাম পাকশিয়ায় স্থাপিত হল ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরি। সম্ভবত বাংলাদেশে সাংগঠনিকভাবে এটিই প্রথম ইউনিয়নভিত্তিক গণপাঠাগার।

বিতর্ক উঠেছিল প্রথম থেকেই। শিক্ষিত মানুষের আড্ডাঘরের জন্য গরীব দোকানি, নিরন্ন চাষীরা কেন সাহায্য করবে? আয়োজকদের ইস্পাত কঠিন পণ প্রভাবশালীদের এড়িয়ে যাওয়ার। জবাব হল, এ আড্ডাঘর বঞ্চিত মানুষের জন্য, গরীব চাষী, ছোট দোকানি, হাটুরেদের জন্য। এখানে সবার আগে সুযোগ পাবে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা। বিনাচাঁদায় বইপড়ার সুযোগ ছাড়াও তাদের জন্য বিশেষ যত্ন নেয়া হবে। কোন শিশু যেন বই না পেয়ে স্কুলছাড়া না হয় তার ব্যবস্থা করা হবে। শুধু পাঠবইয়ের অভাবে সেকালে স্কুলে যেতে পার প্রায় ৫০ ভাগ স্কুল যাওয়ার বয়সী। এমন মহতী উদ্যোগে সহসা সাড়া পড়ে গেল।

পাঠাগারের সাথেই গড়ে তোলা হল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।  পাঠাগার কর্মীই সেখানে স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা করেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে প্রাথমিক স্কুল গড়ার আন্দোলন শুরু হল। সব গ্রামে, সম্ভব হলে পাড়ায় পাড়ায় স্কুল করতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস এক তরুণ ইসমাইল হোসেন। ছোটখাট একটু ব্যবসা করেন। সেটা ছেড়ে সার্বক্ষণিক  কর্মী হয়েই থামলেন না, কলকাকলি নাম দিয়ে এক স্কুল খুলে সত্যিই কাজে নেমে পড়লেন। গ্রামে গ্রামে যান পাঠাগার কর্মীরাই।  গ্রামবাসীকে উদবুদ্ধ করেন নিজস্ব উদ্যোগে স্কুল চালু করতে। তিন ইউনিয়ন জুড়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল। খবর পৌঁছে গেল শার্শা থানা হয়ে জেলা সদর যশোরে। লাইব্রেরি-প্রাণ অধ্যাপক মুহম্মদ শরীফ হোসেন ছুটে গেলেন। উৎসাহে হাওয়া দিলেন স্বয়ং জেলা প্রশাসক আর তার ভ্রমণ সঙ্গী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মুহম্মাদ ইউনূস। জেলা প্রশাসক পাঁচ হাজার টাকার অনুদানও পাঠিয়ে দিলেন, উৎসাহব্যঞ্জক এক চিঠি লিখে।

শিশুরাই হবে এ পাঠাগারের প্রাণ। ছেলেমেয়ে বাদবিছার করা হবে না। মেয়েদের বেশি বশি উৎসাহ দেয়া হল। ঠিক হল, পাঠাগারের প্রাণ যেমন শিশুরা, তেমনি এলাকার বঞ্চিত মানুষও। কীভাবে একটি পাঠাগার গ্রামীণ গরিব চাষী মুজুরদের প্রাণ হবে? তাদের চাষবাসে যাবতীয় আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি সহায়তা যাতে পায় সরকারের কৃষি বিভাগ, মৎস বিভাগ থেকে পাওয়া তার ব্যবস্থা করবে পাঠাগার কর্মীরাই।  সেই সাথে স্বাস্থ্য সেবাও। অর্থাৎ,  শিক্ষা, কৃষি ও স্বাস্থ্য নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল সম্পূর্ণ  স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায়। শিক্ষা স্বাস্থ্য কৃষি আন্দোলনের এক নতুন জমিন তৈরি হল। তখন দেশ জুড়ে এনজিও দাপট  শুরু হয়েছে। বিদেশি সাহায্য নেবার ধূম পড়েছে। এ পাঠাগার নাও বাইল তার উলটো স্রোতে।

এনজিও মানে সুদের ব্যবসা। গ্রামের মানুষের ভাষের বুলিতে নয়া কাবলিওয়ালার দঙ্গল  এখন প্রতিষ্ঠিত এদেশে। বিদেশি টাকায় সুদের ঝুঁকিহীন ব্যবসায়ে সারা দেশ সয়লাব। ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরি সেদিকে ফিরেও তাকাল না।
তাদের শক্তি স্থানীয় জনগণ।  তারাই এর প্রাণ, এর ত্রাণকর্তা।

বড় মাপের কিছু নয়, ক্ষুদ্র পরিসরে ছোট ছোট কাজ। মানুষের কাছে যাওয়া। তাদের সুখ দুঃখের ভাগী হওয়া, পাশে দাঁড়ানো। খোঁজ  খবর রাখা কেউ টাকার অভাবে লেখাপড়া ছেড়ে মাঠে জনমুজুর খাটছে কিনা। অন্তত মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করা, অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে না দেয় সে জন্য গরীব মা-বাবাকে বোঝানো, সাহস দেয়া, পাশে থাকা। গরীব মানুষদের মেয়ে অল্প বয়সে বিয়ে দেবার অনেক কারণ থাকে। তার কিছুটা সংস্কার, কিছু নিরাপত্তার অভাব। সে সব নিয়ে কথা বলা। তাদের স্কুলে যদি দশম শ্রেণি পর্যন্ত ধরে রাখা যায়, বা আরও  একটু ওপরের ক্লাস দ্বাদশ পর্যন্ত পড়ানো যায় তবে অল্প বয়সে বিয়ে ঠেকানো যায়। তাই উদ্যোগ নেয়া কলেজ স্থাপনের। তখন মাধ্যমিক পাস করলে মেয়েরা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেত। সে কথা বলে অভিভাবক, পড়ুয়াকে উদবুদ্ধ করা।

দক্ষ জনসম্পদ তৈরিতেও পাঠাগার কাজ করতে পারে। তেমনি আয়োজন হল চাষীদের নিয়ে বৈঠক, কৃষিবিদ, মৎস কর্মকর্তাদের এনে চাষীদের সাথে মত বিনিময়ের ব্যবস্থা করা। সরকারি ব্যবস্থাকে জনগণের কাছে পৌছে দেবার জন্য লবিং করাই মূল কাজ প্রতিষ্ঠানের। গবাদি পশু পালন, বীজ সংরক্ষণ, সাশ্রয়ী কৃষি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষায় উৎসায়ী করে তোলেন কর্মীরা। আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান। প্রতিযোগিতা, বৃত্তি প্রদান ইত্যাদি।

নানা প্রজাতির গাছের সাথে শিশুদের পরিচিত করতে ছোট্ট আরবরিটুম তৈরি হল। বিভিন্ন দেশের মুদ্রা সংগৃহীত হল। একটা সামাজিক যাদুঘরের মিনিয়েচার রাখা হল। এমনিভাবে নানা কাজে জড়িয়ে গণপাঠাগারটি হয়ে উঠল স্থানীয় মানুষের প্রাণের প্রতিষ্ঠানে।
এখানে বই, খবরের কাগজ পড়া যায়, বাড়িও নেয়া বই। উচ্চ শ্রেণির ছাত্ররা প্রয়োজনীয় বই দীর্ঘ মেয়াদে ধার নিতে পারে। ইচ্ছে করলে সিনেমা দেখা যায়। এ জন্য বিশ্বসেরা সিনেমার একটা সংগ্রহ গড়ে তোলা হল। যুক্ত হল আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা। টেলিফোন এলো, কম্পিউটার এলো গত শতকেই। পরে যুক্ত হল ইন্টারনেট সুবিধাও।

গ্রামীণ সমাজে ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরি  এক নতুন মডেল দাঁড় করিয়েছে। ইউনেস্কো মনে করে, বাংলাদেশে এ মডেল সুফল বয়ে আনবে। তাদের মতে, ইউনিয়ন ভিত্তিক এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সরকার ও জনগণের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। সরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরির প্রত্যক্ষ ও সহায়ক ভূমিকার সুফল ভোগ করছে  ইউনিয়নের বাসিন্দারা। এখানে এখন দুটি ডিগ্রি কলেজ, দুটি বালিকা বিদ্যালয়সহ চারটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার আলোক বিতরণ করছে।

 

লেখক : আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0063388347625732