সম্প্রতি উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যয়ে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। উদ্ধার কার্যক্রম, ত্রাণ সরবরাহ, সুপেয় পানি বিতরণ ও বিপদগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন তারা।
ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে আসা মানুষের জন্য জরুরি প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম। নদী ও বৃষ্টির অব্যাহত পরিবর্তন, নদীর নাব্যতা সমস্যা, এবং অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা মিলিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং জাতীয় পর্যায়ে কার্যকরী মোকাবেলা নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের ভূমিকাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।
জানা গেছে, এই শিক্ষার্থীরা ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। শিক্ষার্থী জাইমা জান্নাত ইশিকা জানান, তারা দুইটি দল গঠন করে সাড়ে ৫ শ'রও বেশি মানুষকে উদ্ধার করেছেন। একটি দল নৌকায় করে ৩৫০ জনকে উদ্ধার করেছে, অন্য দলটি ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন ব্যবহার করে অন্তত ২০০ জনকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে এনেছে। আরেক শিক্ষার্থী সেতাব জাবি ইভান জানান, তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের দিঘীরপাড় এবং বিষ্ণমপুর গ্রামের কয়েক শ' মানুষকে ত্রাণ দিয়েছেন। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ পানি পরিশোধক ব্যবহার করে ৩৫০ লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হয়েছে। শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার পিয়া জানান, জরুরি চিকিৎসাসেবা দেয়া ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়াও তাদের কার্যক্রমের অংশ ছিল। তারা ২ হাজার মানুষের জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন এবং তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের শিক্ষক শাহারিয়ার সরকার বলেন, এল নিনো, বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি লঘুচাপসহ আরও কয়েকটি প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ভারতের রাজ্যগুলোতে খুব অল্প সময়ে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। যার ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ফেনী এবং পাশ্ববর্তী জেলাগুলোতে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করে। আর সেই বন্যার তীব্রতা প্রভাবিত হয় ডুম্বুর ড্যাম খুলে দেয়ার পর। কিন্তু এই গেট খোলার ঘটনা বন্যার একক কারণ নয়। দেশের মানুষকে ভারী বৃষ্টি এবং বন্যা সম্পর্কিত পূর্বাভাস জানাতে আবহাওয়া অধিদপ্তরসহ অন্যান্য দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এর জন্য ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে এবং দুর্যোগ মোকাবেলা কঠিন হয়েছে৷
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোতে ভারতীয় সরকার বিভিন্ন উদ্দেশ্য বাঁধ এবং ব্যারেজ দিয়েছে। এগুলো বাংলাদেশের পানির প্রবাহ, নতুন চর সৃষ্টিসহ জীববৈচিত্রে নানাভাবে নেতিবাচক প্রভাব রাখে। এই নদীগুলোর ভারতীয় অংশের বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত সঠিকভাবে সরবরাহের ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। সেই সাথে বন্যা মোকাবেলায় দুই দেশের সমন্বিত গবেষণা এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার।
শিক্ষার্থীরা জানান, বন্যার্ত এলাকায় জরুরিভিত্তিতে সাড়া দিতে গিয়ে তারা বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। অধিকাংশ মানুষ বন্যার সতর্কতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না এবং নিরাপদ স্থানে যেতে অনিচ্ছুক ছিলেন। এছাড়া বন্যার সময় অনেক চুরির ঘটনা ঘটেছে; এমনকি স্বেচ্ছাসেবকদেরও স্থানীয় গ্রামে গিয়ে চোরদের তাড়াতে হয়েছে। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবকদের থাকার জন্য উপযুক্ত কোন স্থান ছিল না, যা তাদের কার্যক্রমকে কঠিন করে তুলেছিল। এতে বোঝা যায়, এধরনের দুর্যোগ মোকাবেলা করার কোনোপ্রকার অবকাঠামোগত প্রস্তুতি আমাদের নেই।
তারা জানান, তাদের এবারের কার্যক্রমে তারা ৫০টি পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতে সক্ষম হয়েছেন। পাশাপাশি ৫০টি পরিবারকে গবাদি পশু দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চিকিৎসাসেবা সহ অন্যান্য বিষয়গুলো তো ছিলই। সর্বোপরি, 'ডিজাস্টার রেসপন্স'-এর মডেল যেমন হওয়া উচিত, সেই আলোকেই কাজ করেছেন তারা। এছাড়া ওই এলাকার মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে এবং পরবর্তীকালের দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত রাখতে কর্মশালাও আয়োজন করেছেন ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে, পুনর্বাসনের রোল মডেল বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষার্থীদের আরেকটি দল জরিপ কাজ করছেন।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের কর্মসূচিগুলো হতে হবে অভিযোজনমূলক, যাতে জান-মালের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়। আমরা দুর্যোগ মোকাবিলায় তাৎক্ষণিকভাবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করি, সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে। এরপর সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে কাজ হয়। যেকোনো দুর্যোগে দেখা যায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষ এগিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারিভাবে যথেষ্ট ক্ষেত্র না থাকায় কাজের পরিধি সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। যদি প্রত্যেক উপজেলাভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় তা সামাজিক পর্যায়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অভাব রয়েছে দক্ষ জনশক্তির এবং আধুনিক প্রযুক্তির। মাঠপর্যায়ে পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণের অভাবে দুর্যোগের পূর্ব প্রস্তুতির অভাব থাকছে এবং দুর্যোগ পরবর্তী কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি ক্যাচমেন্ট এরিয়ার হাইড্রলিক মডেল ডেভেলপ করার মাধ্যমে বন্যার প্রস্তুতি জোরদার করা সম্ভব।