সিলেট বিভাগের তিন জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। বন্যায় গতকাল পর্যন্ত সিলেট ও সুনামগঞ্জে ১২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। এ দুই জেলায় এক হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। উত্তরাঞ্চলে তিস্তা, করতোয়া, ঘাঘট, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার নদীর পানি বেড়েই চলছে। ফলে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্দা, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া জেলার নদী তীরবর্তী চরাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। অন্যদিকে, ভারী বর্ষণের কারণে পাহাড় ধসে কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও ক্যাম্পসংলগ্ন দুটি পাহাড় ধস এবং পানিতে ডুবে দ্ইু শিশুসহ তিনজন নিহত হয়েছে।
সিলেট জেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। দুই দফা বন্যায় সাত লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি থাকার মধ্যেই গত সোমবার থেকে তৃতীয় দফায় পানি বাড়তে শুরু করে। গতকালও সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারাসহ প্রায় সবগুলো নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল এবং সিলেট নগরীর অনেক এলাকা। তবে মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নতুন করে সুরমা, কুশিয়ারা ও অন্যান্য নদীর পানির উচ্চতা বাড়েনি। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী তিন-চার দিন আরও ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এতে অবনতি হতে পারে বন্যা পরিস্থিতির। এই পরিস্থিতিতে ঈদুল আজহার ছুটির পর প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার সময় হলেও সিলেট জেলায় স্বাভাবিক হচ্ছে না শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষা অফিসগুলো
জানিয়েছে, বন্যাকবলিত ও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় জেলার ৩০৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৩১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
সুনামগঞ্জে দ্বিতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে গতকাল সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমে বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হয়। এখনো রাস্তাঘাট তলিয়ে থাকায় সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, শান্তিগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, মধ্যনগর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার নিম্নাঞ্চলে দুর্ভোগ রয়েছে। জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বন্যাকবলিত লোকজনের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। এছাড়া ৭৭৭টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ৬০টিতে আশ্রয় কেন্দ্রে ১ হাজার ৮৩৭ জন মানুষ অবস্থান করছেন। বন্যাকবলিত ও আশ্রয়কেন্দ্র চালু থাকায় প্রায় ৪০০ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলের পানিতে সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় তিন দিন ধরে এই সড়কে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় আবারও বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, রাজনগর উপজেলার দুটি ইউনিয়ন ও সদর উপজেলার তিন ইউনিয়নে পানি বৃদ্ধি পেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় রূপ নিয়েছে। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে কুলাউড়া পৌরসভার পাঁচটি ওয়ার্ড, কুলাউড়া উপজেলা পরিষদ, জুড়ী উপজেলা পরিষদ এবং ওই সব এলাকার বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট। গতকাল জেলার মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার খরস্রোতা ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর পাহাড়ি ঢলের পানি কমতে শুরু করেছে। পানি কমলেও ভোগাই নদীর গড়কান্দা মহল্লার নতুন বাসস্ট্যান্ড, খালভাঙ্গা, পালপাড়া, নিজপাড়া ও চেল্লাখালী নদীর সন্ন্যাসীভীটা এবং গোল্লারপাড় এলাকায় নদীতীর উচপে ও বেড়িবাঁধ ভেঙে বাঘবেড়, কলসপাড়, নালিতাবাড়ী, যোগানিয়া ও মরিচপুরান ইউনিয়নের কমপক্ষে ১৫টি গ্রামের প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বেশকিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে হাওর অঞ্চলের ৪০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চত্বরে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে।
ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গতকাল দিনভর মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় আতঙ্ক আরও বেড়েছে। প্লাবিত এলাকায় সবজিক্ষেত ও বীজতলা নষ্ট হওয়ায় অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। লোকজন গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
কুড়িগ্রামে উজানের পাহাড়ি ঢল ও কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে কুড়িগ্রামের দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে গতকাল বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে কুড়িগ্রামে দ্বিতীয় ধাপে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমর নদ এলাকার প্রায় ১২০টি চর ও দ্বীপচরে বানের পানি ঢুকে রাস্তাঘাট, পুকুর, গাছপালা ও বাড়িঘড় তলিয়ে গেছে।
ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও করতোয়া নদীর পানি বাড়ছে। তবে এখনো বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদ-নদীর পানি বাড়ায় গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি, মোল্লারচর ও গিদারি; ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি, ফজলুপুর ও কঞ্চিপাড়া এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাপাসিয়া, তারাপুর ও হরিপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি গত দুই দিন ধরে বিপদসীমার কাছাকাছি রয়েছে। জেলার পাঁচটি উপজেলার নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। পাউবোর তথ্য মতে, আগামী দুয়েক দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় জেলার হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে পানি অপরিবর্তিত রয়েছে।
সিরাজগঞ্জে আবারও হু হু করে বাড়ছে যমুনা নদীর পানি। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে যমুনার পানি কাজিপুর পয়েন্টে ৮০ সেন্টিমিটার ও সদর হার্ডপয়েন্টে ৭৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে পানি বাড়লেও গতকাল পর্যন্ত বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বাড়ায় ফের যমুনার অভ্যন্তরীণ চরাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। পাউবো জানিয়েছে, আগামী দুই-তিন দিন যমুনার পানি দ্রুত বাড়তে পারে।
কক্সবাজার উখিয়ায় পাহাড় ধস ও বন্যার পানির স্রোতে দুই শিশুসহ তিনজন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল ভোরে উখিয়া উপজেলার ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এফ-ওয়ান ব্লকে পাহাড় ধসে এর বাসিন্দা দিল মোহাম্মদের ছেলে আনোয়ার হোসেন (২১) নিহত হন। এছাড়া ৮ নম্বর ক্যাম্পসংলগ্ন বালুখালী এলাকায় সিফাত (১৩) নামে এক শিশু মাটিচাপায় মারা যায়। তার বাবার নাম মো. আলম। গতকাল বিকালে বন্যার পানিতে মাছ শিকার করতে গিয়ে স্রোতে পড়ে উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের পূর্ব মরিচ?্যা এলাকার আলি আকবরের ছেলে মো. রাকিব (৭) মারা যায়।