বস্তার গায়ে মিনিকেট লিখলেই ৫ বছরের কারাদণ্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক |

গত ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল চালকল মালিকদের বার্ষিক সাধারণ সভা। পাঁচ তারকা হোটেলে সভা করে মন্ত্রী-সচিব নিয়ে কিছু দাবি আদায়ের কৌশল নিয়েছিলেন মালিকরা। কৌশলটি বুমেরাং হয়ে যায় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের জন্য।

ওই সভায় খাদ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন মিল মালিকদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে সরকার একটি আইন করছে ওই আইনে খাদ্যশস্যকে ভিন্ন বা কাল্পনিক নামে বাজারজাত করলে সেটা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। চালের বস্তার গায়ে মিনিকেট  লিখলে ৫ বছরের কারাদন্ড হবে।

বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, বাজারে বহুল প্রচলিত মিনিকেট বলে কোনো চাল নেই। মিনিকেটের নামে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এই প্রতারণা বন্ধ করার আহ্বান জানান খাদ্যমন্ত্রী।

খাদ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যে মিলাররা প্রথমে মৃদু প্রতিবাদ করেন। তাদের প্রতিবাদ দেখে খাদ্যমন্ত্রী আরও কঠোর হয়ে বলেন, আপনারা মিনিকেটের প্রতারণা বন্ধ না করলে সরকার কঠোর হবে।

খাদ্যমন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের কারণে মিলারদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। হল রুমে উপস্থিত মিলাররা একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকেন। মঞ্চে উপস্থিত মিলমালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ দেশের বড় বড় মিলমালিকরা বিব্রত হচ্ছিলেন।

এই অবস্থায় বক্তৃতা দিতে ডাকা হয় সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরুকে। প্রতিমন্ত্রীর নাম শুনে সবার মধ্যে কৌতূহল চরমে। সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এখানে কেন। প্রতিমন্ত্রী নিজেই কৌতূহল মেটালেন। মঞ্চে উঠেই তিনি ঘোষণা দেন তার একটি চালকল আছে। তিনি চালকল মিলমালিক সমিতির উপদেষ্টাও।

মিলমালিক হয়েও আশরাফ আলী খান খসরু মিলমালিকদের বিপক্ষে অবস্থান নেন। সভায় প্রতিমন্ত্রী বলেন, চালের বাজারে দুটি মিথ্যা তথ্য প্রচলিত। একটি হচ্ছে মিনিকেট, আরেকটি হচ্ছে মিলাররা চাল কেটে সরু করেন। মিনিকেট নামে কোনো জাত নেই আর চাল সরু করাও সম্ভব না। চাল সরু করতে গেলে ভেঙে যায়। তবে বিভিন্ন মেশিনের মাধ্যমে পোলিশ করে চাল চকচক করা হয়।

ওই বৈঠকেই খাদ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন মিলমালিকদের এ দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে সরকার একটি আইন করছে। প্রস্তাবিত আইনটি পাস হলে মিলারসহ, পরিবহন, বিপণন এমনকি মজুদদারদের কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে। সরকার বাধ্য হয়ে এ ধরনের আইন করতে যাচ্ছে।

পরে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ‘খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২২’ মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন হয়েছে। সেখান থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। গত মার্চ মাসে আইনটি অনুমোদন হলেও এখনো ভেটিং শেষ হয়নি।

খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, খসড়া আইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনটির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বাজারে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক ও বাজারে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে। এ আইনে অপরাধীদের শনাক্ত করে সহজেই শাস্তির আওতায় আনা যাবে।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কোনো স্বীকৃত জাতের খাদ্যশস্যকে ভিন্ন বা কাল্পনিক নামে বাজারজাত করে ক্রেতাকে প্রতারিত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধের শাস্তি ৫ বছরের কারাদন্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, মিনিকেট কোনো জাত না। ভারত সরকার নতুন উদ্ভাবিত ধানের বীজ ছোট বা মিনি প্যাকেটে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে দেয়। সেই বীজধান আশির দশকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও আসে। মিনি প্যাকেটে দেওয়া নতুন ধরনের ধানের একসময় নাম হয়ে যায় মিনিকেট। কাজেই মিনিকেট নাম ব্যবহার করা প্রতারণা। নতুন আইনে এ প্রতারণার কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

বর্তমান আইনে রূপক নাম ব্যবহারের কী শাস্তি দেওয়া হয় জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান আইনে এটা অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না। এই ফাঁকফোকর বন্ধ করার জন্যই ‘দ্য ফুড গ্রেইন্স সাপ্লাই’ (প্রিভেনশন অব প্রিজুডিক্যাল অ্যাকটিভিটি) অর্ডিনেন্স, ১৯৭৯ এবং ‘দ্য ফুড’ (স্পেশাল কোর্টস) অ্যাক্ট, ১৯৫৬ যুগোপযোগী করে নতুন আইন হিসেবে প্রণয়ন করা হচ্ছে। 

যেকোনো স্থানে সরকারঘোষিত পরিমাণের বেশি খাদ্যশস্য মজুদ রাখা এবং খাদ্যশস্যের হিসাব কর্তৃপক্ষকে দেখাতে ব্যর্থ হওয়া অপরাধ। অনেক মিলমালিকই পুরনো চাল পলিশ করে সরকারি গুদামে সরবরাহ করে। খসড়া আইনে এটাকেও গুরুতর অপরাধ হিসেবে ধরা হয়েছে।

খাদ্য অধিপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বড় অনেক কোম্পানি রয়েছে যারা চালের ব্যবসা করেন। সম্প্রতি অভিযানের সময় এমন অনেক কোম্পানির নাম এসেছে যারা চাল উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে কোনোভাবেই কাজ করে না। কোম্পানিগুলো তাদের প্যাকেট ঢাকায় প্রিন্ট করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের চালের মিলগুলোতে দিয়ে আসে। সেসব মিল নামকরা কোম্পানির মনোগ্রামখচিত প্যাকেটে চাল ভরে রাখে। পরে বড় বড় কোম্পানির গাড়ি গিয়ে ওসব চালের প্যাকেট সারা দেশে বিক্রি করে। এই প্রক্রিয়ায় বড় কোম্পানিগুলোর কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। খসড়া আইনে এটা অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে এবং ৫ বছরের জেলের বিধান করা হয়েছে।

খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমরা অভিযানে বিভিন্ন মিলে বড় বড় বেসরকারি কোম্পানির প্যাকেট পাই। তারা ওসব মিলে প্যাকেট দিয়ে আসে। এটাও অপরাধ।’

খসড়া আইনে আরও বলা রয়েছে, সরকারি গুদামের খাদ্যশস্যভর্তি বস্তা পুনরায় সরকারের কাছে বিক্রি করা, সরকারি গুদামের সিলযুক্ত চাল বিক্রির প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি হবে। প্রকল্পে বিতরণকৃত চাল পরিমাণে কম দেওয়া, উপকারভোগী ছাড়া অন্য কাউকে দিলেও শাস্তি হবে।

সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল  বলেন, সরকার চালের জন্য আর কতকাল মিলমালিকদের ওপর নির্ভর করবে। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্থানীয় বাজার থেকে খাদ্যশস্য কিনলে সমস্যার সমাধান হতে পারে। এতে মৌসুমে বাজার চাঙ্গা থাকবে, কৃষক উপকৃত হবে এবং মিলারদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024781227111816