স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিবশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে ২৬ মার্চ থেকে সংঘটিত ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে নারকীয় তাণ্ডব হয়েছে, তা অনেকের কাছে অভাবনীয় মনে হলেও মোটেই অদৃষ্টপূর্ব নয়। এর আগেও ১৯৯৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উৎসব উপলক্ষে তারা হরতাল ডেকেছিল। রোববার (১৮ এপ্রিল) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, ওই উৎসব উপলক্ষে এনজিও সংগঠন প্রশিকার তৃণমূল সংগঠনের সারাদেশ থেকে আসা নারী-পুরুষের ওপর হামলা হয়েছিল তো বটেই, তবে যে বিষয়ে মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা বিশেষ উৎসাহী ছিল, তা হলো নারীদের লাঞ্ছনা করা, শারীরিকভাবে নির্যাতন করা। এবারের মতো সেবারও ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রশাসন ওই হরতালের দিন শহর থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এবার অবশ্য পুলিশ আর বর্ডার গার্ড মোতায়েন ছিল। কিন্তু আগের দিন শহর ও শহরতলির তিনটি অংশে সংঘর্ষে ৫ জনের মৃত্যু হওয়ায় তারা পিছিয়ে গিয়েছিল কিনা বলতে পারছি না। এ কারণেই সম্ভবত স্থানীয় সংসদ সদস্য ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে ওই হরতালে নেতৃত্বদানকারী জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসা আক্রমণের অভিযোগ তুলেছেন, যা স্থানীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্য অনুযায়ী সর্বৈব মিথ্যা। প্রশাসন ১৯৯৮ সালেও প্রশিকার কাজী ফারুকের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির অভিযোগ এনেছিল। এবারে প্রশাসন সে কথা না বললেও আইজিপি সদলবলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাবলি পরিদর্শন করে লম্বা-চওড়া এক সংবাদ সম্মেলন করলেও স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেছেন কিনা উল্লেখ করেননি অথবা এ ধরনের কোনো সংবাদও প্রকাশিত হয়নি। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হেফাজত স্থানীয় সংসদ সদস্যকে 'অবাঞ্ছিত' ঘোষণা করেছে। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র বা জেলার তরফ থেকে এর কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিবিধানের ব্যবস্থা হয়েছে কিনা তাও জানা যায়নি।
শুরুতেই যে কথা বলেছিলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাবলি অদৃষ্টপূর্ব নয়; বরং ১৯৯৮ সালে যে ঘটনা ঘটেছিল, তারই পুনরাবৃত্তি এবং বৃহত্তর পরিসরে। সে সময় ওই ঘটনাবলি সম্পর্কে তদন্ত কমিটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানবাধিকার কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছিল, তা ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করায় পরদিনই ওই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আকসির এম চৌধুরীকে (যিনি সে সময় জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ও বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য) ফাঁসির দণ্ড দেয় মোল্লারা। তারা তার শহরের বাসা আক্রমণ করলে বৃদ্ধ মা, বোবা স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে নিয়ে পালিয়ে জীবন বাঁচান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সে সময়ে ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ সরকার তাকে কোনো নিরাপত্তা দেয়নি। এমনকি স্থানীয় আওয়ামী লীগ এর প্রতিবাদ করেনি। বরং ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরের ওই ঘটনাবলির কিছুদিন পর আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন আইনমন্ত্রী সদ্য প্রয়াত সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু এমপি মাদ্রাসা ইউনুসিয়ায় 'বড় হুজুর' সত্তরোর্ধ্ব মাওলানা সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তার ফল আমরা দেখেছিলাম পরের বছরের সেপ্টেম্বরে।
ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বে দেশে সব এনজিও কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয় এবং ঘোষণা দেওয়া হয় যে, তা না হলে সারাদেশে হরতাল পালন করে এনজিও অফিসগুলো দখল করে মক্তব ও মাদ্রাসায় রূপান্তরিত করা হবে। মাওলানা ফজলুল হক আমিনী বর্তমানে বেঁচে নেই, তবে তার জীবদ্দশায়ই দেখে গিয়েছিলেন ইউনুসিয়া মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণে আরও ৫০-৬০টি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবারের হরতালে ওই একইভাবে ইউনুসিয়া মাদ্রাসারই নেতৃত্বে কয়েকশ ছাত্র-শিক্ষক তিন দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলে রেখেছিল এবং ১৯৯৮ সালে যেমন 'বিজয় উৎসবের আয়োজনকারী প্রশিকা অফিসসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব এনজিও অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের প্রতিষ্ঠিত পাঠাগার, শিশুদের জন্য স্কুল, নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ধ্বংস সাধন করেছিল, এবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারি স্থাপনাগুলো, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, পৌর মিলনায়তন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতায়ন, গণগ্রন্থাগার, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অঙ্গন, স্বাধীনতা উৎসবের স্থাপনাগুলো আর বিশেষ করে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, যা একদিকে যেমন একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দেয়, তেমনি মনে করিয়ে দেয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট খুনির গুলিতে জর্জরিত বঙ্গবন্ধুর লাশের চিত্র।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রতিক তিন দিনের ঘটনাবলির সঙ্গে ১৯৯৮ সালের দিনগুলো, সময়কাল ও অভ্যুত্থানের সাযুজ্য শনাক্ত করতে খুব পর্যবেক্ষণ শক্তির প্রয়োজন হয় না। ১৯৯৮ সালে আক্রমণের লক্ষ্য ছিল 'বিজয় উৎসব' আর আক্রমণের অজুহাত ছিল নারী-পুরুষের একত্র সমাবেশ ও এনজিওগুলোর ধর্মবিরোধী তৎপরতা। এবারের ঘটনার শুরু হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের দিন, অজুহাত মোদির আগমন, অভিযোগ মোদির মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপ। সে সময় যেমন আক্রমণকারীদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উৎসব, এবারও ঘটনার শুরু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী দিয়ে। এর আগে 'বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে' ১৭ মার্চ তার জন্মদিনের দু'দিন আগে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার সংখ্যালঘু গ্রামে আক্রমণ করা হয়। এখানেও আক্রমণকারীদের স্লোগান ছিল, 'হেফাজতের অ্যাকশন, ডাইরেক অ্যাকশন,' 'মামুনুল হকের অ্যাকশন, ডাইরেক অ্যাকশন'। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে কোনো ভুল হয়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযুদ্ধের স্মারকসমূহসহ আনন্দ মানের মন্দিরও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জঙ্গি ইসলামী খেলাফত আইএস-এর আক্ষরিক পরাজয় ঘটলেও তাদের মানসিক পরাজয় ঘটেনি। বিভিন্ন দেশেই তারা নতুনভাবে পুনর্গঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। আফগানিস্তানের তালেবানরা আরও বহু ধাপ এগিয়ে সেখানে ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের করা শান্তিচুক্তি অনুসারে সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করা হলে তারা সত্বরই কাবুল দখল করে নেবে- আফগানিস্তানের বর্তমান প্রশাসকরা সে রকমই ধারণা করেন। সুতরাং বাংলাদেশে আমিনীর তালেবানি বিপ্লবের স্লোগান আবার উচ্চারিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। তারই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে কওমি মাদ্রাসাগুলোতে হেফাজতের যে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তার ভিত্তিতে ওইসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকদের দিয়ে তাণ্ডব চালিয়ে। এ কারণেই কওমি মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপে তারা রাজি নয়। এমনকি এই কভিডকালে সারাদেশে লকডাউন দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ, তখন কওমি মাদ্রাসা বন্ধ রাখার নির্দেশ তারা মানতে অস্বীকার করেছে। হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি সভা করে কওমি মাদ্রাসা ও হেফজখানাগুলো খুলে দেওয়ার দাবি করেছেন হেফাজতের আমির বাবুনগরী। নইলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা নেবে বলে হুমকিও দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কওমি মাদ্রাসার সনদ দিয়ে হেফাজতকে সন্তুষ্ট রাখতে চেয়েছিলেন। তারা তাকে 'কওমি জননী' উপাধিও দিয়েছিল। এখন এটা বোঝা যায় যে, পরের পোলাকে নিজের পোলা করা যায় না। একটু সাবালক হলেই ওই পালিতপুত্র জননীকে অস্বীকার করে নিজের শিকড়েই ফিরে যায়। এখানে তো কওমি মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণে সামান্যতম ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। সুতরাং তারা নিজেদের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমরা কি বাংলাদেশে আরেকটি তালেবানি অভ্যুত্থানের জন্য অপেক্ষা করছি?
বিশেষ দ্রষ্টব্য: আফগানিস্তান ও পাকিস্তান অঞ্চলে মাদ্রাসাছাত্রদের তালেবান বলা হয়।
লেখক : সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, সভাপতি, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পাটি
