বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

গুণগত শিক্ষা বা মানসম্মত শিক্ষা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। এটি উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল বিশ্বেও শিক্ষাবিদদের মনোযোগ আকর্ষণ করে চলেছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো টেকসই উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে গুণগত শিক্ষার ধারণা ও গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরেছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময়কে ‘জাতিসংঘ শিক্ষা দশক’ হিসেবে গণ্য করে ইউনেস্কো গুণগত শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, উপাদান ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে। এ সংস্থা গুণগত শিক্ষাকে টেকসই উন্নয়নে শিক্ষার পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এবং ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অভীষ্ট ফলে গুণগত শিক্ষার বিকাশ ঘটতে পারে বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন। এক্ষেত্রে ইউনেস্কো দ্বিমত পোষণ করে বলেছে, শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত বিকাশ একই সঙ্গে ঘটতে পারে। বৃহস্পতিবার (৩ জুন) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, একথা সর্বজনবিদিত যে স্বাধীনতার পর অল্প সময়ের মধ্যেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকারি করার পদক্ষেপ নেন। ফলে প্রাথমিকে মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারের পথ সুগম হয়েছে। পরে সব সরকারের আমলেই এ ধারা রক্ষা করা হয়েছে। প্রাথমিকের তুলনায় মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার মান আশাব্যঞ্জক নয়। বর্তমান সরকারের আমলে গত দশকে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় বালক ও বালিকা উভয়েরই অংশগ্রহণের হার অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে এবং একই সঙ্গে বিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাধারার সঙ্গে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাধারাও প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি সাধনে এগিয়ে এসেছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বলা চলে, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণগত বিকাশ অনেকখানি হয়েছে। তবে গুণগত তেমন উন্নয়ন ঘটেনি।

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

গুণগত শিক্ষার অনেক অপরিহার্য পূর্বশর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে অধিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। একথা অনস্বীকার্য, বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে খরচ করা হয় না, যা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে সামগ্রিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাত্র শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষা উপখাতে বরাদ্দ মাত্র শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ, যা সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। উল্লেখ্য, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোট জিডিপির তুলনায় যথাক্রমে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান জাতীয় বরাদ্দ শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ থেকে ক্রমান্বয়ে ২০২২ সালের মধ্যে ২ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ শতাংশে উন্নীত করা আবশ্যক। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের বর্তমান বরাদ্দ ৮ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল বাজেটে শিক্ষা খাতে ৬৬ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২৪ হাজার ৯৪০ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ৩৩ হাজার ১১৭ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসাশিক্ষার জন্য ৮ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। শিক্ষা খাতে এ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল মোট ব্যয়ের ১১ দমমিক ৬৯ শতাংশ। উল্লেখ্য, গত কয়েকটি বাজেটে শিক্ষা খাতে টাকার অংকে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেলেও জিডিপির তুলনায় তাতে খুব বেশি হেরফের হয়নি। একথা অনস্বীকার্য যে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ হলো উন্নত জাতি গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ। অথচ এখানে যৎসামান্য বরাদ্দ দেয়া হয়, তাতে শিক্ষার মান বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা তো দূরের কথা, দেশীয় মানটাও ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধানতম উপায় হলেও বাংলাদেশে শিক্ষায় অর্থায়ন এখনো হতাশাজনক। ইউনেস্কো গঠিত ‘একবিংশ শতাব্দীর জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন’ তথা দেলরস কমিশন প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। জাতীয় উন্নয়ন অর্জন করতে হলে উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রধান উপাদান। বর্তমানে যে পরিমাণ অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়, তা অপ্রতুল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশে ৫ ডলার, শ্রীলংকায় ১০ ডলার, ভারতে ১৪ ডলার, মালয়েশিয়ায় ১৫০ ডলার ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬০ ডলার।

দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

আমরা জানি, গুণগত শিক্ষা কোনো একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে অর্জনের আশা করা যায় না। এজন্য প্রয়োজন অনেকগুলো উপাদানের সমন্বিত এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও কর্মকাণ্ড। গুণগত শিক্ষার জন্য যেসব উপাদানের যথাযথ সমন্বয় সাধন করতে হয়, সেগুলো হচ্ছে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান সামগ্রী ও ভৌত অবকাঠামো, যথার্থ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি, ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ ইত্যাদি। শিক্ষার সব স্তরে গুণগত মান অর্জনের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সুপারিশগুলোর আলোকে আসন্ন বাজেট ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নীতিনির্ধারণ করা জরুরি।

যেকোনো পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণের পর একজন চাকরিপ্রত্যাশী যাতে দ্রুত কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, এটি নিশ্চিত করা দরকার। শিক্ষিত হয়ে কাউকে যাতে বেকার থাকতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে কর্মসংস্থানের সঙ্গে মিল রেখে পাঠ্যসূচিতে প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন জরুরি হয়ে পড়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়কে যদি উচ্চশিক্ষায় যথাযথ গুরুত্বারোপ করা হয়, শিক্ষকদের অব্যাহত প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যায়, শিক্ষার পুরো প্রক্রিয়াকে যদি সমৃদ্ধ করা যায়, তাহলে উচ্চশিক্ষার হারের ঊর্ধ্বগতির সুফল আমরা পাব। শিক্ষার মান বাড়াতে যা যা করণীয়, সময়মতো প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে।

কয়েক বছর পরপর শিক্ষাক্রমে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে হয়, এটি চলমান এক প্রক্রিয়া। তবে এ পরিবর্তন যেন অর্থবহ হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে আগামীতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে, সেভাবে তাদের গড়ে তুলতে হবে।  তা না হলে উচ্চ আয়ের যে লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সে লক্ষ্যে কাঙ্ক্ষিত সময়ে পৌঁছতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

নৈতিকতাবিষয়ক সংকট—এটি এখন সারা বিশ্বেই এক বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। আমাদের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে নৈতিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার। বাংলাদেশ, ভারতসহ প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উন্নত নৈতিকতা চর্চার ঐতিহ্য রয়েছে, এটি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্যে অত্মকেন্দ্রিক মনোভাবের প্রবণতা বেড়েছে। নানা কারণে নৈতিকতা চর্চায় অনেক আগ্রহ কমেছে। এটা চিন্তার বিষয়। উচ্চ নৈতিকতা ও উন্নত মূল্যবোধের সঙ্গে শিশুরা যাতে ভালোভাবে পরিচিত হতে পারে, সেজন্য প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকেই যথাযথ গুরুত্বারোপ করা উচিত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হওয়ার আগেই শিশু যাতে উচ্চ নৈতিকতা ও উন্নত মূল্যবোধের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, সেজন্য মা-বাবাসহ পরিবারের অগ্রজ সব সদস্যকে সতর্ক থাকতে হবে।

শিক্ষার প্রাথমিক স্তরেই শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রযুক্তির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত করানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আশার কথা হলো, এরই মধ্যে এ-বিষয়ক অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়া আধুনিক জীবনযাপনের অপরিহার্য অন্যান্য প্রযুক্তির সঙ্গেও শিক্ষার্থীদের পরিচিত করানোর উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নত দেশের শিশুরা একেবারে শৈশবে স্কুলে যাওয়ার আগে কম্পিউটারসহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পরিবারেই পেয়ে থাকে। আমাদের দেশে তেমনটি না হলেও আজকাল অনেক সচ্ছল পরিবার ও জ্ঞানের দিক থেকে অগ্রসর মানুষ শিশুদের আধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত করানোর চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু এ ধরনের সুযোগ সীমিতসংখ্যক পরিবারের শিশুরা পেয়ে থাকে। এটি বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থায় এসটিইএমের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। এস মানে সায়েন্স, টি মানে টেকনোলজি, ই মানে ইঞ্জিনিয়ারিং, এম মানে ম্যাথমেটিকস। সেখানে কোনো শিক্ষার্থী যে বিভাগেই অধ্যয়ন করুক না কেন, তাকে চারটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে আত্মস্থ করতে হয়। আজকের যুগে প্রযুক্তি ছাড়া জীবনধারণের কথা কল্পনাই করা যায় না। সেজন্য কম্পিউটার সায়েন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং—এসব বিষয়ের মৌলিক দিকগুলো সম্পর্কেও অল্পবয়সী প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ধারণা থাকা দরকার।

আজকের যুগে একজন শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন কেন প্রয়োজন, তা সবারই জানা। মাতৃভাষা হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। তার পরেও যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ইংরেজি শেখায় গুরুত্ব দেয়া হয়। চীন, জাপান, কোরিয়া এসব দেশে ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি বহুল আলোচিত। আমরা মাতৃভাষায় চিন্তা করব, কল্পনা করব, স্বপ্ন দেখব; তবে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে যেসব ভাষায় দক্ষতা বাড়ানো দরকার, সেসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলে চলবে না।

গণিতকে বলা হয় বিজ্ঞানের জননী। শুধু তাই নয়, গণিত দর্শনেরও জননী। আড়াই হাজার বছর আগে প্লেটোর স্কুলে বিজ্ঞান অধ্যয়নের ভালো ব্যবস্থা ছিল; সেখানে গণিতের চর্চাকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঁচ হাজার বছর আগে গণিতের চর্চায় বেশ অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ভারতবর্ষের কথা উল্লেখ করা যায়। বিজ্ঞানের গবেষণা বর্তমানে এমন উচ্চপর্যায়ে চলে গেছে যে মানুষের মস্তিষ্ক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যৌথভাবে কাজ করে কোনো সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া খুঁজে বের করে। কাজেই এমন গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক তথ্য গল্পচ্ছলে তুলে ধরা হলে এরাই বড় হয়ে মহাকাশবিষয়ক গবেষণায় বেশি আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে।


চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত বিভিন্ন আলোচনা এখন উচ্চশিক্ষার স্তরেই সীমিত রয়েছে। এ প্রবণতা হয়তো আরো কিছুদিন চলমান থাকবে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই এসব আলোচনা আর উচ্চশিক্ষার স্তরে সীমিত থাকবে না। এ-বিষয়ক অনেক তথ্যকে সাধারণ জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হবে। আমরা যদি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল বেশিমাত্রায় পেতে চাই, তাহলে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই সে-সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রাসঙ্গিক আলোচনা শুরু করতে হবে। এ-সম্পর্কিত জ্ঞানের আলোচনার অন্যতম প্রধান বার্তাটি হলো, জ্ঞানচর্চায় কোনো বিভাজন থাকা অনুচিত। জ্ঞানের সমন্বিত চর্চা ছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল পাওয়ার কথা চিন্তা করা যায় না।

বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সব স্তরে দক্ষতার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। এর বিপরীতে অপচয়ের হার কমিয়ে দক্ষতার মান বাড়াতে আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ দক্ষতা ও অপচয় রোধ করতে হবে, যাতে মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সত্যিকারের মানবসম্পদে রূপান্তর করা যায়। মূল্যায়ন ও পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার সাধন করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের সব দিক অর্থাৎ স্বাস্থ্য, আচার-আচরণ, প্রকাশভঙ্গি, মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা ইত্যাদি বিবেচিত হয় এবং তথ্য সংগ্রহকরণ কৌশল ও বিশেষায়িত ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্ভব হয়। সিলেবাসকে অযথা ভারাক্রান্ত না করে তা শিক্ষার্থীর চাহিদা, বয়স, মেধা ও গ্রহণযোগ্যতা অনুযায়ী হওয়া উচিত। দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, দীর্ঘদিনের লালিত ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় চেতনা, বিশ্বাস এবং নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন যাতে হয়, সেসব দিক বিবেচনায় রেখে পাঠ্যসূচি তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজনে বর্তমান পাঠ্যসূচি সংকোচন করতে হবে। দুর্বল বা কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা কিংবা স্কুলে আলাদা কোচিংয়ের মাধ্যমে তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে তোলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীর জন্য উপবৃত্তির বা বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের বিষয় নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে অভিভাবক, বিদ্যালয় বা শিক্ষকদের ইচ্ছা ও পছন্দ মোতাবেক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। কোনো শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কী হতে চায় কিংবা কোন বিষয় নিয়ে পড়তে চায়, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীর পছন্দ বা মতামতকে প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক। এতে তার পঠিতব্য বিষয় সম্পর্কে শ্রদ্ধা জাগবে, ফলে সে পাঠে মনোযোগী হবে, শিক্ষা গ্রহণ করে পরিতৃপ্ত হবে এবং আশানুরূপ ফলাফল করবে।

গুণগত শিক্ষার জন্য যে উপাদানটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষক। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। সব শিক্ষকের জন্য বুনিয়াদি ও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কর্মরত শিক্ষকদের জন্য কর্মকালীন প্রশিক্ষণ এবং প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সঞ্জীবনী কোর্সের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং একই সঙ্গে শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করতে অবশ্যই যথোপযুক্ত বেতন-ভাতা দিয়ে তাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও পেশাগত স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।

সার্কভুক্ত ভারত, শ্রীলংকা এবং উন্নত দেশের ন্যায় শিক্ষকদের সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণ, মেয়াদি/ বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণে সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ মর্মে একটি নীতিমালা বা পরিপত্র জারি করা প্রয়োজন যে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সব শিক্ষককে পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে।

দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে নিত্যনতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ফলে উন্নয়ন  কৌশল ও পদ্ধতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের অবশ্যই কারিগরি ও বৃত্তিমূলক পেশার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে এবং বিদ্যালয়ের পঠিত বিষয় হিসেবে একে বাধ্যতামূলক করতে হবে। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যুক্তিসংগত অনুপাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশাল শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের সম্মুখে শতাধিক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে যে কী গভীর সমস্যার সৃষ্টি করে, তা সহজেই অনুমেয়। এজন্য পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রে ঘটে অনিবার্য বিপর্যয়। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত একটি যুক্তিযুক্ত সীমার মধ্যে রাখতে হবে, যা প্রাথমিক স্তরের জন্য ১:৩০, নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য ১:৪০ এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ১:২৫-এর বেশি না হয়। প্রতি বছর বিদেশী ঋণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তা কতটুকু মানসম্পন্ন এবং লব্ধ প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয় পর্যায়ে কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা নিবিড়ভাবে মনিটর করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতা প্রয়োগে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে উত্তরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

দেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত অর্থায়ন পর্যাপ্ত নয় এবং প্রকৃত বরাদ্দ মোট জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এ বছর গতানুগতিক বাজেট দিয়ে কভিড-১৯ অতিমারীর ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। করোনার কারণে সারা দেশে ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক শিক্ষা গ্রহণ ব্যাহত হচ্ছে। এর ক্ষতি ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। আসছে অর্থবছরে শিক্ষা খাতের এ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার উদ্যোগ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, করোনার কারণে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের মা-বাবার আয় কমে গেছে, এ শিশুরা পুষ্টি ঘাটতিতে পড়েছে। করোনার কারণে বাল্যবিবাহ ও ঝরে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। শিশুশ্রমও বাড়ছে। শিক্ষায় চলমান এ বিপর্যয় রোধকল্পে শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা আবশ্যক। উপরন্তু, ইউনেস্কো গঠিত দেলরস কমিশন প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত মোট বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার জন্য যে সুপারিশ করেছে, বাংলাদেশকে তা মেনে চলতে হবে। এ-সংক্রান্ত সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার গুণগত ও পরিমাণগত দিক সুষম ও সুসংহত হবে।  

সেই সঙ্গে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, বিষয়ে বৈচিত্র্য আনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নবতর জ্ঞানের দিগন্ত উন্মোচন এবং উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিশ্বমানের গবেষণা কার্যক্রম নিশ্চিতকরণে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির কোনোই বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান সুসংহতকরণে ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বাস্তবায়ন কার্যক্রমকে গতিশীল রাখার জন্য জাতীয় বাজেটে উচ্চশিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করে শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও সরকার যৌথভাবে বহুমাত্রিক কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তবেই বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে সক্ষম হবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে শামিল হতে পারবে। শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে এটাই হোক মুজিব বর্ষের প্রত্যাশা।

লেখক : ড. মো. ফখরুল ইসলাম, গবেষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035781860351562