বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় ভিন্ন চিন্তা

শান্ত কৈরী |

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান নিম্নমুখী বহুবছর ধরেই। শুধু উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নয়, মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক পর্যায়েও যাচ্ছেতাই অবস্থা। করোনার পর তো শিক্ষার অবস্থা আরো খারাপ। পৃথিবীতে এত দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখা হয়েছে, এমন দেশ আর একটাও আছে কিনা জানা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিলো। আমি যেখানে পড়ছি, সেখানে সশরীরে ক্লাস হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সব খুলে দেয়া হয়েছে। এ পক্রিয়াটা আরো দ্রুত হতে পারতো। 

শিক্ষা নিয়ে এদেশে অনেক কথা হয়। সমস্যা নিয়ে কথা হয়, সমাধান নিয়ে নয়। সমাধানের নামে বছর বছর সিলেবাস পরিবর্তন আর ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন নতুন পদ্ধতির গিনিপিগ বানানো হয়। এছাড়া উচ্চশিক্ষার কথা তো বাদই দিলাম। আজকের পর্বে এসব নিয়ে কথা না বলে এমন একটা ইস্যু নিয়ে কথা বলা উচিত, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বাড়তি বিকল্প যোগ করবে। 

আমাদের দেশের একটা বড় অংশের ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় না, তো কেউ জাতীয়তে, কেউ কেউ টাকার অভাবে পড়তে পারে না প্রাইভেটে। আবার আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় অনেকের চাকরি করে নিজের খরচ চালাতে হয়। কাউকে কাউকে ছাত্রাবস্থাতেই চালাতে হয়। এতে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যায়। আবার অনেকের বয়স হয়ে যাওয়ায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিতে চায় না। কেউ কেউ শুধু বাসা থেকে অনেক দূরে যেতে পারবে না, বা থাকার জায়গা নেই, টাকা নেই অথবা শুধু মেয়ে হবার জন্য শহরে আসতে পারে না বা অন্য শহরে যেতে পারে না, তাদের জন্য একটা বিকল্প ব্যবস্থা খুব জরুরি। 

করোনায় পড়ালেখার যে ক্ষতি হয়ে গেছে, তার একটা সুরাহা অনেক আগেই দরকার ছিলো। এখনও প্রাসঙ্গিকতা শেষ হয়ে যায়নি। দরকার এমন যেন যারা উচ্চতর শিক্ষা ছেড়ে দিয়েছে তাদের একটা গতি করার। দরকার একটা ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়। সারাবিশ্বে ‘ডিস্টেন্স লার্নিং’ নামক শিক্ষা শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন কোর্স, ডিগ্রি এবং ডিপ্লোমার দিকে ঝুঁকছে। এর মাধ্যমে দুনিয়ার যে কেউ তার শিক্ষা কার্যক্রম বাসায় বসে হোক, পাহাড়ে থেকে হোক, চালিয়ে যেতে পারে। ব্যাপারটা আমাদের দেশেও অনতি বিলম্বে শুরু করা উচিত। 

আমাদের যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে, তাদের হাতে এরকম শিক্ষা দেয়া যাবে না। তারা এখন নিজেদের ছাত্রদেরই শিক্ষা দেয়ার মতো অবস্থায় নেই। এর জন্য দরকার একটি ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়। যখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের ছাত্রদের প্রয়োজন মেটাতে পারবে, তারাও এমন ‘ডিস্টেন্স লার্নিং’ কর্মসূচি হাতে নিতে পারবে। আমাদের এর জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিস্থাপন দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশের কালিয়াকৈরেই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নতুন করে সাজিয়ে আমাদের করোনার ধাক্কা কিছুটা সামলে যারা পড়ালেখা থেকে ছিটকে গেছে বা যাচ্ছে, তাদেরও ফিরিয়ে আনা যাবে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকে দুইভাগে ভাগ করা যাবে। একভাগ একাডেমিক, অন্যভাগ গবেষণার। একাডেমিক ভাগে অনার্স, মাস্টার্স, আন্ডারগ্রাড ডিপ্লোমা, পোস্টগ্রাড ডিপ্লোমা এবং স্পেশালাইজড কোর্সের ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট পরীক্ষা নেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, পরীক্ষা এবং অ্যাসাইনমেন্ সব হবে অনলাইনভিত্তিক। শুধু ভর্তি আর সার্টিফিকেট  তোলা বাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার দরকার হবে না। ট্রান্সক্রিপ্ট পর্যন্ত অনলাইনে পিডিএফে আপলোড হয়ে যাবে। দরকারে সার্টিফিকেট আসবে কুরিয়ারে। এখানে সুবিধা হবে এটাই যে, সবাই প্রতিদিন অনলাইনে ক্লাস করবে, অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্ জমা দেবে। পরীক্ষা হবে অল্প কিছু নম্বরে। অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক পড়ালেখাই হবে মূলত। অ্যাসাইনমেন্ট বাইরের কাউকে দিয়ে করানো যাবে না, শিক্ষক তার ক্লাসের টপিকের ওপর ভিত্তি করে অ্যাসাইনমেন্ট করাবেন। 

আমরা করোনার মধ্যে এভাবেই ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট পরীক্ষা চলতে দেখেছি। এভাবে ডিগ্রি দেয়াতে সমস্যা হবার কথা নয়। সুবিধা হলো যে, সবাই তার ইচ্ছামতো সেমিস্টার নিয়ে, কোর্স নিয়ে, নিজের গতিতে পড়া শেষ করবে। অনলাইনে শ’য়ে শ’য়ে ছাত্রকে সহজের পাঠদান করা যায়, যা ক্লাসরুমে সম্ভব নয়। অতএব খুব খারাপ হবার কথা নয়। 

যিনি শিক্ষক হবেন, তিনি শুধু এখানের শিক্ষক হবেন। তার কাজ হবে তার নিজের বাসায় বসে ক্লাস করানো এবং শ’খানেক অ্যাসাইনমেন্ট দেখা প্রতিদিন। তার সর্বোচ্চ একটা বা দুইটা কোর্সের দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু অনেক বেশি ছাত্রের দায়িত্ব নিতে হবে বাসায় বসেই। অফিস করার ঝক্কি ঝামেলা নেই। 

যে কেউ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবেন না। কোর্স নাম্বার ১০০-১৯৯ এবং ২০০-২৯৯ নিতে পারবেন মাস্টার্স পাস শিক্ষক। কিন্তু ৩০০-৬০০ পর্যন্ত কোর্স নিতে হলে অবশ্যই পিএইচডিধারী হতে হবে। শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে পরের পর্বগুলোতে ধারণা দেয়া হবে। 

দ্বিতীয় ভাগ হবে গবেষণা ও তথ্যপ্রযুক্তি। এই অংশ গবেষণা করতে থাকবে কীভাবে অনলাইন পাঠদান আরো ভালো এবং নিরবচ্ছিন্ন করা যাবে। সাথে তথ্যপ্রযুক্তি ভাগ চেষ্টা করবে বিশ্বমানের ওয়েবসাইট তৈরি, অনলাইন ক্লাসরুম তৈরি, অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্ট জমাদানের পোর্টাল, অনলাইনে ফলাফল এবং মেইন্টেইনেন্স। গবেষণার মাধ্যমে আরো জানা যাবে কীভাবে ধীরে ধীরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ও এভাবে তাদের পাঠদানের একটা মাধ্যম গড়ে তুলবে।  

যারা বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়বেন তাদের জন্য একটি বা সেমিস্টার রাখা হবে। রেসিডেন্সিয়াল সেমিস্টার। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এই সেমিস্টার শুধুই ব্যবহারিকভাবে করবেন। দরকার হলে দুই সেমিস্টার রাখা হবে। ব্যবহারিক, প্রজেক্ট এবং থিসিসের জন্য। এই সেমিস্টারের দায় নেবে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় নিজে হোস্টেলের ব্যবস্থা করবে এক বা দুই সেমিস্টারের জন্য যেন ছাত্র ব্যবহারিক শিখতে পারে। যারা বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়বে তারা বেশিরভাগই কম বয়সের হবে। তাদের এখানে থেকে এক বা দুই সেমিস্টার পড়া খুব একটা সমস্যার হবার কথা না। যারা চাকরি করছিলেন ঢাকার বাইরে, কিন্তু বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং নেবেন তারা এসে শেষ সেমিস্টারগুলো এখানে পড়তে পারবেন। এতে চাকরি ছেড়ে আসলেও এমন এক সময়ে আসা হবে যেন তারা পাস করে আরেকটা চাকরি পাবেন, এমন একটা ব্যবস্থা থাকে। থিসিস এবং ব্যবহারিক সেমিস্টারে ছাত্ররা শুধু ফ্রিতে হোস্টেলে থাকবে তাও নয়, একটা সরকারি বৃত্তি পাবে যেন বাড়িতে টাকা পাঠানোর দরকার হলে তারা সেই সাহায্য করতে পারে। 

বেতন? খুব বেশি হবার কথা নয়। যেহেতু অনেক ছাত্র হবে, বছরে পনেরো থেকে বিশ হাজার হলেই হয়ে যাবার কথা। খরচ নির্ভর করবে সম্পূর্ণই কত কোর্স নিচ্ছে এর ওপর। এখান থেকে টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চলবে, শিক্ষকদের বেতন হবে এবং বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিয়ারিংয়ের ছাত্রদের এক দুই সেমিস্টারের খরচ দেয়া হবে। 

করোনা পরিস্থিতি যাদিও এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আগামীতে করোনার অন্য ধরন বিপরর‌্যয় ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। তাছাড়া এ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক সময়েও যে উচ্চ শিক্ষা কার‌্যক্রমে বিশেষভাবে সহায়ক হবে তা নিয়ে বোধ করি কারোই সংশয় থাকা উচিত নয়। তাই আরো দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই কাজটা শুরু হলে ভালো হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই বোধ হয় আমরা কাজটা শুরু করতে পারি। 

প্রথম পর্ব

লেখক : ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক শিক্ষক, যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিকাল সাইন্সে মাস্টার্স অধ্যয়নরত   

 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049808025360107