আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো রয়ে গেছে মান্ধাতার আমলে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সিলেবাস, পরীক্ষার পদ্ধতি, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের প্যারামিটার কোনোকিছুর উন্নতি হয়নি। বর্তমান সময়ে দক্ষ জনশক্তি একটি দেশের উন্নয়নের জন্য খুব জরুরি। আধুনিক যুগে জনসংখ্যা বেশি হওয়াকে সমস্যা হিসেবে অনেক চিন্তাবিদ চিহ্নিত করেন না। উলটো ‘পপুলেশন ডিভিডেন্ট’ নামক একটা টার্ম ব্যবহার করে থাকেন, যার অর্থ জনসংখ্যার সুবিধা।
দক্ষ জনশক্তি যে কোনো দেশের জন্য অনেক বড় সম্পদ। ভিয়েতনাম, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র তাই দেখিয়েছে বিগত বছরগুলোতে। আমরা যখন এখানে শিক্ষা নিয়ে কথা বলছি, বলে রাখা জরুরি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। তৈরি করছে লাখে লাখে শিক্ষিত অদক্ষ বেকার। এরা বেশিরভাগই চাকরির বাজারে কোনোভাবেই নিজেকে প্রমাণ করতে পারছে না। দেশের অনেক চাকরিতেই বিদেশিদের প্রাধান্য দেখা যায়। চাকরি না পেয়ে অনেক বেকার বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ।
দেশে বেশিরভাগ চাকরিতেই পোস্ট গ্রাজুয়েশন বা স্নাতকোত্তর যোগ্যতার দরকার পড়ে। ডিগ্রি হিসেবে এমবিএ বেশি দামী এখন। স্নাতকোত্তর পাশ করেই কতজন দক্ষ হচ্ছে? এতো হাজার লাখ স্নাতকোত্তর বেকার দিয়ে কী করবে বাংলাদেশ যদি তাদের কাজে লাগানো না-ই যায়?
অনেকে বলেন, বাংলাদেশকে কারিগরি শিক্ষার দিকে ঝুঁকতে জাপানের মতো। ছোটবেলায় রচনা পড়তাম, কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। শুধুই কি কারিগরি শিক্ষা দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব একটা দেশে? এরকম সরল একমুখী চিন্তা দিয়ে তো কোটি মানুষের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। আরো কিছু অপশন জরুরি হয়ে পড়ে।
সবার শিক্ষা জরুরি এবং সেটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু অনেকের পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। অনেকের পরিবারের বা জীবিকার জন্য পড়ালেখা বন্ধ করে কাজে চলে যেতে হয়। অনেকে শুধু উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন চাকরির জন্য। উচ্চশিক্ষা আসলে দরকার কিছু বিশেষ চাকরির জন্য এবং গবেষণার জন্য। আর সবার তো স্নাতকোত্তর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন চাকরির জন্য, নিজের ক্যারিয়ার এগিয়ে নেয়ার জন্য দক্ষতা। আর দক্ষতার জন্য ডিপ্লোমা শিক্ষার প্রসার ঘটানোর দরকার।
স্নাতকোত্তর সবার দরকার নেই। যারা স্নাতক, কিন্তু চাকরিতে যাবেন তারা স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা করবেন। ক্লাস হবে বিকেলে যেন দিনে তারা চাকরির পড়া পড়তে পারেন বা চাকরি করতে পারেন। অনেকেই অফিসে ডেস্ক সম্পর্কিত কাজ করেন। তাদের জন্য স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা ম্যানেজমেন্টে। কেউ হোটেলে কাজ করবেন, তার জন্য হোটেল ম্যানেজমেন্ট ডিপ্লোমা। কেউ সোশাল ওয়ার্ক করবেন তার সে বিষয়ে ডিপ্লোমা, কেউ ব্যাংকে কাজ করবেন তার জন্য ব্যাংকের ডিপ্লোমা। ডিপ্লোমা প্রয়োজন অনুযায়ী চারমাস থেকে দুইবছর স্থায়ী হবে। এখানে থিওরির পাশাপাশি হাতে-কলমে কাজ শেখা হবে। শেখা হবে কম্পিটার আর ইন্টারেনেটের ব্যবহার, মুখোমুখি যোগাযোগ (যাকে কমিউনিকেশন এবিলিটি বলে) এবং বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান।
যারা কলেজের পরপরই চলে যেতে চান চাকরিতে, তাদের জন্য থাকবে তাদের ইচ্ছেমতো বিষয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা। সেখানেও তারা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত সিলেবাসে ডিপ্লোমা করে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হবে। যারা নাইনেই পড়া শেষ করতে চায় বা এসএসসি পাশ করে না বা পাশ করার পর চাকরি করতে চায়, তারাও স্কুল ডিপ্লোমার মাঝ দিয়ে যেতে পারে। দেশে এখনই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিপ্লোমা চালু আছে এসএসসির পরপরই। অন্যান্য বিষয়ের জন্যও এরকম ডিপ্লোমা চালু করতে হবে। সেটা হোক না গার্মেন্টের জন্যও।
উচ্চশিক্ষার ওপর চাপ কমিয়ে সেখানে শিক্ষার মান ধরে রাখতে উচ্চশিক্ষাকে বিকেন্দ্রীকরণও জরুরি। দক্ষ জনশক্তি খুব জরুরি যদি বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে এগিয়ে যেতে চায়। শিক্ষার মান ধরে রাখতে এবং ব্যাঙের ছাতার মতো ডিপ্লোমা ইন্সটিটিউট যেন গড়ে না ওঠে এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মনিটরিংয়ে এসব ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা জরুরি। আর পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও করা যেতে পারে কারণ সান্ধ্যকালীন ডিপ্লোমা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন নয়।
চেষ্টা করলে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু কে করবে?
লেখক: শান্ত কৈরী, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক শিক্ষক, যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিকাল সাইন্সে মাস্টার্স অধ্যয়নরত