পৃথিবীর প্রথম ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল চীনে। ১৬০ খ্রিষ্টাব্দে চীনের ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারের কয়েকটি নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলো। সেই আন্দোলন ছুঁয়ে গিয়েছিলো সাধারণ মানুষকেও। কারাগারে যেতে হয়েছিলো ১৭২ জন শিক্ষার্থীকে। এভাবেই ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ হতে থাকে। বাংলাদেশের অভ্যুত্থানেও ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলো ছাত্র সমাজ। যুগে যুগে ছাত্ররাই অধিকার আদায়ে মাঠে নেমেছে। তারা জয়ী হয়ে ফিরেছে। নয়তো ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থেকেছে।
চলুন জেনে নেই বাংলাদেশের তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন—
৫২ এর ভাষা আন্দোলন
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দেশভাগের পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার আন্দোলন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা শহরের ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এ আন্দোলনে নামেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে গুলি করে শাসকরা। বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা।
৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর আইয়ুব খান শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। তাতে আইয়ুব খানের সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা সংকোচন নীতির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিলো। রিপোর্টে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রকট হয়। এ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য ১৯৬০-১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা হয়। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনেও বাধা আসে।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলে ফেব্রুয়ারিজুড়ে আন্দোলন চাঙা থাকে। শিক্ষার্থীদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আগস্টে ছাত্র ধর্মঘট ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেয়া হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর আন্দোলন পরিণতির দিকে যায়। যোগ দেয় সাধারণ মানুষ। হরতালের মিছিলে পেছন থেকে আক্রমণ করে পুলিশ ও ইপিআর। দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ হয় কোর্ট এলাকায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ৩ জন। আহত হন অনেকে। গ্রেফতার হন শত শত শিক্ষার্থী।
৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের ছাত্ররা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের ডাক দেন। তারা সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এটিই মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়লেও ছাত্রদের ভূমিকা কম ছিলো না। ছাত্ররা মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তারা পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নেন।
৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে স্বাধীন দেশের ছাত্ররা এরশাদ সরকারের পতন ঘটান। এর জন্য কঠিন আন্দোলন করতে হয়েছে। নূর হোসেন এই আন্দোলনে শহীদ হন। যার বুকে-পিঠে লেখা ছিলো ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। এ আন্দোলনে ছাত্ররা সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং সরকারের পতন নিশ্চিত করেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন
২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের ছাত্ররা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত সরকার কোটা ব্যবস্থা সংস্কারে বাধ্য হয়। কোটা প্রথাই বাতিল ঘোষণা করা হয়।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে সড়কের নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে নামে সহপাঠিরা। এ আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন পায়। সরকারকে সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য করা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট পদত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত জুলাই মাস থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংহিসতায় ২ শতাধিক ছাত্র-জনতা শহীদ হন। ফলে দিন দিন উত্তাল হয় সারাদেশ। এক পর্যায়ে সারাদেশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সাধারণ ছাত্র-জনতার হাতে। ফলে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।
ছাত্র আন্দোলন সব সময়ই পরিবর্তনের শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে ছাত্ররা তাদের অধিকার ও ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। তাদের সংগ্রাম এবং ত্যাগের মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। যার প্রভাব এখনও বিদ্যমান।