বাংলাপ্রেমী শিক্ষক উইলিয়াম রাদিচে আর নেই

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

বাংলাপ্রেমী শিক্ষক, কবি ও প্রবন্ধিক উইলিয়াম রাদিচে আর নেই। গতকাল ১১ নভেম্বর নিজের জন্মদিনেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে  লন্ডনে জন্মানো এই ব্রিটিশ শিক্ষক লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের বাংলার সিনিয়র লেকচারার ছিলেন। লন্ডনেই তিনি মারা যান। 

ভাষাবিজ্ঞানী ও ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের বার্তা সম্পাদক আবু জার মো: আক্কাস তার ফেসবুকে স্মৃতিচারণে লেখেন, বাংলা ভাষার স্বজন উইলিয়াম রাদিচে। আজ (১১ই নভেম্বর) মারা গেছেন। তাঁর জন্মও আজকের দিনে, সালটা ১৯৫১। ভদ্রলোক ভারি সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতেন। একবার তাঁর আবৃত্তিতে explosion শব্দটি শুনে বিস্ফোরণ দেখতে পেয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা চারবারের মত। প্রথমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটারে, গেল শতকের নয়ের দশকের একদম শুরুতে। মধুসূদন এবং মিল্টনের আলোচনা। দুটো প্রশ্ন করেছিলাম। তাঁর নামের উচ্চারণ নিয়ে। বাংলা পত্রিকাগুলো তখন র‍্যাডিস লিখত। উত্তরে বললেন, নামের উচ্চারণ হবে রাদিচে, ইতালীয়। বাংলা বলার সময় ঠেকে যান না, কিন্তু পড়ার সময় কেঁপে কেঁপে পড়েন কেন? উত্তর ছিল—তিনি ইংরেজি হরফে লেখা বাংলা পড়ছেন, সে কারণেই এরকমটা হচ্ছে। এর পরে একবার, সেটাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। ২০০৫-এ একবার গুলশানের দিকে কোনো একটা হোটেলে একটা বক্তৃতার ওপর বিপোর্ট করতে গিয়ে তৃতীয় বার। হোটেলের নাম মনে নেই। রিপোর্টটাও খুঁজে পাচ্ছি না। এর দুয়েক দিন পরে, তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল। সেই হোটেলে বসেই। শুরুতে জিজ্ঞেস করলেন, ইংরজিতে বলতে পারেন কি না? উত্তরে বলেছিলাম, বাংলায় বলতে অসুবিধে আছে কি না। পরের দেড় ঘণ্টা বাংলায় কথা হয়েছে। সাবলীল বাংলা। দুয়েকবার ঠেকে গেছেন। তাঁর লেখা একমাত্র বাংলা কবিতা ‘আদিয়াবাদ‘ পড়ে শোনালেন। সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল নিউ এজে, ২০০৫-এর ১৪ই এপ্রিল, বৈশাখী সংখ্যায় (https://www.ajmakkas.com/pages/n_wradice.html)। এর বেশ কিছুদিন পর, সোয়াস থেকে কেউ একজন তাঁর দূর্ঘটনায় আহত হবার খবর দিয়ে একটি ই-মেল পাঠান। আমি তখন বার্তা সম্পাদক। শেষের পাতার জন্য একটি রিপোর্ট লিখেছিলাম। এরপর মাঝেমাঝে মনে হয়েছে তিনি কেমন আছেন। কোনো খবর জোগাড় করে উঠতে পারিনি। তাঁর তিনটে বই আমার কাছে আছে। বাংলা একাডেমি থেকে ছাপানো ‘চারটি বক্তৃতা’, অ্যানভিল প্রেস থেকে ছাপানো ‘লাউয়ারিং স্কাইজ়‘ আর হডার অ্যান্ড স্টৌটনের ছাপানো ‘টিচ ইয়োরসেল্ফ বেঙ্গলি’। শান্তিতে সমাহিত থাকুন!

 

কয়েকবছর আগে প্রকাশিত বিশিষ্ট প্রবন্ধিক ও গবেষক গোলাম মুরশিদের লেখায় জানা যায়, উইলিয়াম রাদিচে বাংলা শিখেছিলেন বাংলা শিখবেন বলেই। অক্সফোর্ডে ইংরেজিতে ডিগ্রি করার পর তিনি ভাবছিলেন, অতঃপর কী করবেন। ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যে তাঁর আগ্রহ ছিল। তিনি একাধারে মৌলিক কবি এবং অনুবাদক। অক্সফোর্ডে তিনি তরুণ কবি হিসেবে পুরস্কারও লাভ করেছিলেন। সে যা-ই হোক, অক্সফোর্ডের অধ্যয়ন শেষ করে যখন তিনি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা ভাবছিলেন, তখন তাঁর এক বাঙালি বন্ধু তাঁকে বাংলা পড়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, কাজ করার মতো অনেক উপাদান তিনি বাংলা ভাষায় পাবেন।  বাংলাদেশের গৌরবজনক স্বাধীনতাসংগ্রাম তাঁকে উদ্দীপ্ত করেছিল। বঙ্গদেশ এবং বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর আরও একটা দূরবর্তী আকর্ষণ ছিল—একসময় তাঁর পিতামহ এবং তারপর তাঁর পিতৃব্য বঙ্গদেশে আইসিএস অফিসার হিসেবে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেই সূত্রেও তিনি নিশ্চয় ছেলেবেলা থেকে বঙ্গদেশ এবং ভারতবর্ষের অনেক গল্প-কাহিনি শুনে থাকবেন, যা তাঁকে বঙ্গদেশ সম্পর্কে কৌতূহলী করে থাকবে।

অক্সফোর্ডে বাংলা শেখার ব্যবস্থা ছিল না, তাই উইলিয়াম রাদিচে বাংলা শিখতে যান লন্ডনের সোয়াসে। সেখানে তিনি বিভাগের প্রভাষক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে বাংলা শেখেন। তার আগেই ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে ক্লার্ক সাহেব মারা গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অধ্যাপক। তাঁর জায়গাতে জন ব্লোল্টন আর তারাপদ মুখোপাধ্যায় প্রভাষক হন। তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে উইলিয়াম রাদিচে ভালো করেই বাংলা শেখেন, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যিক বাংলা। আমার ধারণা, তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে রবীন্দ্রসাহিত্যেও তাঁর হাতেখড়ি হয়। রবীন্দ্রসাহিত্য দিয়ে সূচনাই হওয়াই তো স্বাভাবিক।

তিনি বিশেষ করে আকৃষ্ট হন রবীন্দ্রনাথের কাব্য পড়ে। তিনি রবীন্দ্রনাথের কাব্য অনুবাদ করতে আরম্ভ করেন। তাঁর সেই অনুবাদের মধ্য থেকে ৪৮টি নানা স্বাদের কবিতা নিয়ে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: সিলেকটেড পোয়েমস নামে একটি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশক পেঙ্গুইন বুকস। এই সংকলন প্রকাশিত হওয়ার পর পশ্চিমা বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ যেন নতুন জীবন লাভ করেন। 

উইলিয়াম রাদিচের প্রধান কৃতিত্ব এই যে তিনি বিচিত্র আঙ্গিক এবং নানা স্বাদের মাত্র ৪৮টি কবিতার কাব্যানুবাদ করেন ‘আধুনিক’ ইংরেজিতে এবং সেই অনূদিত কবিতা দিয়ে এমন একটি সংকলন প্রকাশ করেন, যা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ইংরেজ পাঠকদের কৌতূহল নতুন করে জাগিয়ে তোলে। এতে ‘দুই বিঘা জমি’র মতো আখ্যানমূলক কবিতা যেমন ছিল, তেমনি ‘সোনারতরী’, ‘সাজাহান’ এবং শেষ দিকের গদ্যকবিতাও ছিল। বিশেষ করে ব্রিটেনে তখন দ্য রাজ কোয়ার্টেট উপন্যাসগুচ্ছ এবং তার ওপর ভিত্তি করে রচিত টিভির একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান ‘দ্য জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’, একাধিক নামকরা চলচ্চিত্র গান্ধী, আ প্যাসিজ টু ইন্ডিয়া ইত্যাদি ফেলে আসা ভারতবর্ষ সম্পর্কে ব্রিটেনে যে নস্টালজিয়া জেগে উঠেছিল, তা-ও রবীন্দ্রনাথের পুনর্জাগরণে সহায়তা করে। সেই সঙ্গে অনুবাদক হিসেবে রাদিচেও পরিচিতি লাভ করেন।

রাদিচের এই অনুবাদগ্রন্থটি আকারে ছিল ছোট, কিন্তু অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর ইংরেজ কবি ও সম্পাদক ক্যাথলিন রেইন এর সমীক্ষা করতে গিয়ে লিখেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ যে এত বড় কবি ছিলেন, তা তিনি এ গ্রন্থ পড়ার আগে জানতেন না। এখন তিনি অনুভব করছেন যে বিশ শতকের দুই শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন উইলিয়াম ইয়েটস আর রবীন্দ্রনাথ। এই একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, রাদিচের চটি বইটি রবীন্দ্রনাথকে কেমন নতুন জীবন দান করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ বইয়ের ভূমিকাটি রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে পাঠকদের একটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ধারণা দেয়।

একবার এই নির্বাচিত কবিতাসংকলনের মাধ্যমে সাফল্য লাভ করার পর রাদিচে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অনুবাদে হাত দেন। কবিতার রস আস্বাদনে যেমন তার পরিবেশ সম্পর্কে পরিচিতি একান্ত আবশ্যিক নয়, ছোটগল্প সম্পর্কে সে কথা খাটে না। ছোটগল্পের স্বাদ পেতে হলে সেই জগৎ সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণার দরকার হয়। সে জন্য ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে যখন রবীন্দ্রনাথের নির্বাচিত গল্পের অনুবাদ পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত হয়, তখন তা কবিতার মতো অতটা সমাদর লাভ করেনি। তবে এ বইয়ের পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। কেবল তা-ই নয়, এরপর ছোটগল্পের আরও একটি সংকলন প্রকাশ করেন কাবুলিওয়ালা নামে। তবে রাদিচে উপলব্ধি করেন যে রবীন্দ্রনাথের সত্যিকার অনুবাদের ক্ষেত্র তাঁর গল্প, উপন্যাস অথবা নাটক নয়, সে হলো তাঁর কবিতা। তাই তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার আরও একাধিক সংকলন প্রকাশ করেন। এমনকি কণিকা, লেখন এবং স্ফুলিঙ্গর ক্ষুদ্র কবিতাও অনুবাদ করেন (২০০৪)।

তিনি সোয়াস থেকে বাংলা শেখার কোর্স শেষ করে ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে আরম্ভ করেন। তাঁর গবেষণার নির্দেশক ছিলেন ঐতিহাসিক অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী। আমি কখনো রাদিচেকে সরাসরি জিজ্ঞেস করিনি, কিন্তু অক্সফোর্ডে তিনি পড়তেন খুব সম্ভব খণ্ডকালীন ছাত্র হিসেবে। বাকি সময় পড়াতেন একটা স্কুলে। পরে তিনি সোয়াসের শিক্ষক হন (১৯৮৮) প্রথমে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে, তারপর প্রভাষক এবং সবশেষে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে। তিনি তখন ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বিভাগীয় প্রধান হিসেবেও কাজ করেন। এ সময়ে তাঁর বয়স মাত্র ৫০ বছর। কিন্তু তখনই তিনি অবসর নিয়ে নিজের কাজে আত্মনিয়োগ করতে চান।

রাদিচের পরিচয় শিক্ষক হিসেবে যতটা, তার চেয়ে তিনি ঢের বেশি পরিচিত কবি, লেখক এবং অনুবাদক হিসেবে। তাঁর নয়টি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং কবি হিসেবে তিনি পুরস্কারও লাভ করেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁর খ্যাতি এসেছে অনুবাদের পথ ধরে। তিনি অসামান্য অনুবাদক। তাঁর অনুবাদ সঠিক হওয়া সত্ত্বেও সৌভাগ্যক্রমে তা আক্ষরিক নয়। তিনি এক ভাষার ধারণা এবং ভাবটি অনায়াসে অন্য ভাষায় সঞ্চারিত করে দেন। সে জন্য কোনো কোনো বাঙালি সমালোচক বাংলা কোনো শব্দ, অণুবাক্য অথবা বাক্য তুলে ধরে তার সঙ্গে ইংরেজির তুলনা করে তাঁর অনুবাদে আক্ষরিক অমিল দেখিয়েছেন। এ কেবল তাঁর অনুবাদের প্রতি অবিচার নয়, সামগ্রিকভাবে উত্তম অনুবাদের প্রতিই অবিচার। আমার ধারণা, কবি অথবা শিক্ষকের চেয়েও অনুবাদক হিসেবে রাদিচে শ্রেষ্ঠ।

অনুবাদে সৃজনশীলতার আরেকটি অসাধারণ পরিচয় রাদিচে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষের সময়ে। এ সময়ে তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলি নতুন করে অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ যখন নির্বাচিত শতাধিক গান এবং কবিতার গদ্যানুবাদ নিয়ে ইংল্যান্ডে যান এবং সেখানকার গুণীজনদের পড়ে শোনান, তখন তা শুনে তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক মাস পর যখন এই গান ও কবিতাগুলো ছাপানো হয়, তখন তা খানিকটা মাজাঘষা করেছিলেন উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস। কেবল তা-ই নয়, রবীন্দ্রনাথ যে ক্রম অনুযায়ী রচনাগুলো সাজিয়েছিলেন, সেগুলোরও পরিবর্তন করেছিলেন। কিন্তু ১০০ বছর পর ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম রাদিচে মূলের ক্রম ফিরিয়ে আনেন এবং রবীন্দ্রনাথের মূল অনুবাদের পাশাপাশি আধুনিক ইংরেজিতে রচনাগুলোর পদ্যানুবাদও প্রকাশ করেন। ফলে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির মাধ্যমে পাঠকদের হৃদয়ে যে রস সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, প্রথমবারের মতো পাঠকেরা তার স্বাদ পেলেন রাদিচের অনুবাদে। একে ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন না বলে বলা হয়েছে ট্রান্সক্রিয়েশন।
বস্তুত, অনুবাদ করতে গিয়েও রাদিচে তাঁর সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন নানা দিক দিয়ে। দ্য পোয়েম অব দ্য কিলিং অব মেঘনাদ নামে তিনি মেঘনাদবধ কাব্য-এর যে উৎকৃষ্ট অনুবাদ করেন, তাতেও তিনি এই সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রথমেই তিনি যে সমস্যার মুখোমুখি হন, তা হলো এ কাব্যের ছন্দ—ব্ল্যাঙ্ক ভার্স নিয়ে। মাইকেল অমিত্রাক্ষর নামে বাংলায় এই ছন্দের যে রূপান্তর ঘটান, তাতে সমস্যা কিছু কম ছিল না। কারণ, ইংরেজিতে ব্ল্যাঙ্ক ভার্স কেবল অন্ত্যমিলহীন ১০ মাত্রার ছন্দ নয়, তাতে ঝোঁকযুক্ত এবং ঝোঁকহীন অক্ষর একটা বিশেষ শৃঙ্খলায় সাজানো থাকে এবং তার ফলে ছন্দে একটা সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় এবং অর্থ প্রকাশেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে নাটকের জন্য এ ছন্দ অত্যন্ত উপযোগী। (শেক্সপিয়ার যার ব্যাপক ব্যবহার করেছেন।)

মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন নাটক এবং কাব্যের প্রয়োজনে অমিত্রাক্ষর ছন্দ নির্মাণ করেন, তখন তার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেন ১৪ মাত্রার পয়ারকে। অন্ত্যমিল পুরোপুরি বর্জন করেন। কিন্তু বহু জায়গাতেই পর্ববিভাগ মেনে নেন অথবা তাকে এড়াতে পারেননি। কোনো কোনো জায়গায় একটা বাক্য শেষ হয়েছে দুই, আড়াই, তিন, সাড়ে তিন পঙ্ক্তিতে। রাদিচে এ দিকটার দিকে লক্ষ রেখে তাঁর পঙ্ক্তিগুলোর দৈর্ঘ্যের হেরফের ঘটিয়েছেন। কিন্তু তিনি যেভাবেই তাঁর পঙ্ক্তিগুলো সাজিয়ে থাকুন না কেন, পড়তে গেলে বাংলা অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। ক্লিনটন সিলিও আটলান্টিকের অপর তীর থেকে মেঘনাদবধ কাব্যের অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু রাদিচে পঙ্ক্তিগুলোর দৈর্ঘ্যে বৈচিত্র্যের আমদানি করে সমস্যার যে সমাধান করেছেন, ক্লিনটন সিলি ১৪ মাত্রার পঙ্ক্তি বজায় রেখেও তা করতে পারেননি। রাদিচে যে মৌলিক কবি, তা-ও এ ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রাদিচের মতো সিলি কবি নন।

সোয়াসের লেখাপড়া শেষ করে উইলিয়াম রাদিচে অক্সফোর্ডে ভর্তি হন, আগেই বলেছি। সেখান থেকে ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ডিফিল ডিগ্রি অর্জন করেন (অক্সফোর্ডে পিএইচডি নেই)। তাঁর বিষয়বস্তু ছিল মাইকেল মধুসূদনের জীবন ও সাহিত্য। জীবনী নিয়ে তিনি মৌলিক গবেষণা করেননি। যোগীন্দ্রনাথ বসু, নগেন্দ্রনাথ সোম এবং সুরেশচন্দ্র মৈত্রের ওপরই তিনি নির্ভর করেন। সত্যিকারের কৃতিত্ব তিনি দেখান মাইকেলের সাহিত্য বিশ্লেষণে। যেমন: কবির সাহিত্য বিশ্লেষণ করেই তিনি মন্তব্য করেন যে মাইকেলের জীবন ও সাহিত্যে খ্রিষ্টীয় পরিচয় ছিল আন্তরিক। মাইকেলের আরও একটি বৈশিষ্ট্যের কথা সবার আগে তিনি উল্লেখ করেন। সে হলো মাইকেলের সাহিত্য এবং চিঠিপত্রে হাস্যকৌতুকের সূক্ষ্ম প্রকাশ। তাঁর আগে এদিকে অন্য কেউ মনোযোগ আকর্ষণ করেননি। কিন্তু তাঁর এ আলোচনার পর এ সম্পর্কে কারও আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। তাঁর আরেকটি সুবিধা ছিল, তিনি ধ্রুপদি বিদ্যাচর্চা করেছিলেন। কাজেই তাঁর পূর্ববর্তী সমালোচকদের তুলনায় তিনি অনেক গভীরভাবে মাইকেলের ওপর গ্রিক, ইতালিয়ান এবং ইংরেজি ধ্রুপদি সাহিত্যের প্রভাব নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। তাঁর ডিফিল ডিগ্রি হয়ে যাওয়ার পর তিনি মাইকেলের জীবনী নিয়ে কোনো প্রবন্ধ রচনা করেননি। কিন্তু মাইকেলের ওপর ইংরেজি এবং ইউরোপীয় ধ্রুপদি সাহিত্যের প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন। আলোচনা করেছেন মাইকেল সাহিত্যে পরজাতি-বৈরিতা নিয়েও।

উইলিয়াম রাদিচের আরেক অতুলনীয় অবদান হলো বহু অজানা দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে, যেখানে বাংলা ভাষা নামে একটি ভাষার কথাই জানা ছিল না এবং জানা ছিল না বাংলা সাহিত্যের ঐশ্বর্যমণ্ডিত ঐতিহ্যের কথা, সেসব দেশে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খবর পৌঁছে দিয়েছিলেন। রাদিচের অন্যান্য অবদানের মূল্যায়ন নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পতাকাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার ব্যাপারে, তাঁর অবদান যে সুবিস্তৃত এবং অতুলনীয়—সে সম্পর্কে সন্দেহের কারণ নেই।

বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য ছাড়াও ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যান্য বিষয় নিয়েও কাজ করেছেন। যেমন: ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে যাঁর অবদান ছিল সম্ভবত সবচেয়ে বেশি, সেই মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনীর ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকা লিখেছেন তিনি। বইটির শতাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। গর্বিত খ্রিষ্টান মাইকেল তাঁর বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে একদা লিখেছিলেন যে তিনি হিন্দুধর্মকে একচুলও তোয়াক্কা করেন না। কিন্তু হিন্দু পুরাণের শ্রেষ্ঠত্ব একেবারে তুলনাহীন। সেই পুরাণ সম্পর্কে অনেকেরই স্পষ্ট অথবা অস্পষ্ট কোনো ধারণাই নেই। বিশেষ করে যাঁরা ভারতীয় ভাষা জানেন না। এই অভাব পূরণের জন্য রাদিচে প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার মিথস অ্যান্ড লিজেন্ডস অব ইন্ডিয়া নামে একটি বিশাল গ্রন্থ প্রকাশ করেন ২০০২ সালে। এই গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য হলো এতে কেবল হিন্দুধর্মীয় পুরাণকথাই স্থান পায়নি, সেই সঙ্গে মুসলিম, জৈন, বৌদ্ধ এবং লৌকিক কাহিনিও জায়গা করে নিয়েছে। তাঁর ভারত বহু-সাংস্কৃতিক ভারত—এ গ্রন্থেরও একাধিক সংস্করণ হয়েছে।

রাদিচে যখন সার্বক্ষণিক গবেষণা এবং কাব্যচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করার জন্য প্রস্তুত, তেমন সময় ২০১২ সালের মে মাসে একটা অত্যন্ত গুরুতর দুর্ঘটনায় পতিত হন। একটা চলন্ত ট্রাক তাঁকে ধাক্কা দেয়। ফলে তিনি দেহের বিভিন্ন স্থানে গুরুতররূপে আহত হন। বিশেষ করে মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন তিনি। তবে সৌভাগ্যক্রমে তাঁকে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় এবং সেখানে অত্যন্ত উন্নত মানের চিকিৎসাসেবা লাভ করেন। তিনি লাইফ সাপোর্টেই ছিলেন ছয় সপ্তাহ। এত দীর্ঘ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর আবার সুস্থ হয়ে ওঠার দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিরল। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ঢাকা বোর্ডে জিপিএ-৫ বেড়েছে ২০০ - dainik shiksha ঢাকা বোর্ডে জিপিএ-৫ বেড়েছে ২০০ ‘আহতদের আমৃত্যু চিকিৎসা ও পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে’ - dainik shiksha ‘আহতদের আমৃত্যু চিকিৎসা ও পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে’ ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ ইউজিসির - dainik shiksha ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ ইউজিসির পুরনো পদ্ধতিতে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা - dainik shiksha পুরনো পদ্ধতিতে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক জাবির প্রশাসনিক ভবন থেকে ‘শেখ মুজিবের’ ছবি অপসারণ - dainik shiksha জাবির প্রশাসনিক ভবন থেকে ‘শেখ মুজিবের’ ছবি অপসারণ ইএফটি সংক্রান্ত নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha ইএফটি সংক্রান্ত নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024960041046143