এ দেশে অতি পরিচিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। দূরশিক্ষণ শব্দটিও এখন আর কারো অজানা নয়, কিন্তু এই দুরশিক্ষণ জিনিসটি আসলে কী সে বিষয়ে অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণার যথেষ্ট অভাব রয়েছে, এমনকি এই দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষা পরিচালনার সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত তাদেরও অনেকেরই এ বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ না থাকায় তারা দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিকে গুলিয়ে ফেলেন।
আবার দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছাড়াই অগণিত শিক্ষার্থী উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই কর্তৃপক্ষের নিকট ছুটে আসেন তাদের নিয়মিত ক্লাসের আয়োজন করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের জন্য আবাসিক হল তৈরি করতে হবে এবং যাতায়াতের জন্য বাস সার্ভিস চালু করতে হবে—এমন দাবি নিয়ে। আসুন, এ বিষয়ে সংক্ষিপ্তাকারে একটি স্পষ্ট ধারণা নেয়া যাক।
সংজ্ঞা অনুযায়ী দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে শারীরিক ব্যবধান থাকবে অর্থাৎ শিক্ষকের সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে বসে শিক্ষার্থীদের সরাসরি শিক্ষাগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই, ঘরে বসে ছাপানো বই, মডিউল, বিভিন্ন মিডিয়া এবং অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে তারা শিক্ষা গ্রহণ করবেন। তবে দূরশিক্ষণ বা ডিস্ট্যান্স লার্নিং এর পাশাপাশি উন্মুক্ত বা ওপেন শব্দটিও পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ওপেন লার্নিং সিস্টেম একটু ভিন্ন। এ পদ্ধতিতে ছোটোখাটো সমস্ত বাধা অতিক্রম করে সকল পর্যায়ের শিক্ষায় জনগণের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত ও তরান্বিত করার সমস্ত ব্যবস্থা রাখা হয় যেখানে নারী-পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গ উভয়েই বয়স, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও জাতি নির্বিশেষে সকল শ্রেণির জনগণ উন্মুক্ত আলোচনা, টিউটোরিয়াল, সেমিনার, পরিদর্শন, প্রদর্শন, ল্যাবরেটরি ওয়ার্কশপ, বেতার, টেলিভিশন, ইন্টারনেটসহ যাবতীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এ জন্যই এ পদ্ধতিকে উন্মুক্ত পদ্ধতি বলা হয়। উল্লিখিত পদ্ধতিদ্বয় একে অন্যের পরিপূরক তাই উভয়ের সমন্বয়ে এই শিক্ষা-পদ্ধতিকে সংক্ষেপে ওডিএল(ODL- Open and distance learning) নামে অভিহিত করা হয়। এই শিক্ষা-পদ্ধতির বৈশিষ্ট হলো- জ্ঞানার্জনে আগ্রহী যে কেউ তার পারিবারিক ও অন্যান্য কাজের পাশাপাশি নিজের অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে স্বল্প ব্যয়ে মডিউল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জীবনব্যাপী শিক্ষায় অংশ নিতে পারেন এবং নিজেকে একজন যোগ্য ও দক্ষ বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছেটাই সবচেয়ে বড় কথা।
ওপেন ইউনিভার্সিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টি- প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের উদ্যোগে। মিল্টন কেইনস এ অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টিই বিশ্বের প্রথম এবং বৃহত্তম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটির ইতিহাস একটু ভিন্ন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত আইনটি(১৯৯২ সনের ৩৮ নং আইন) মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ অক্টোবর এবং সে অনুযায়ী দেশের একমাত্র উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ অক্টোবর।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী এবং ইসলামিক স্কলার ড. এম শমশের আলী ওপেন লার্নিং কনসেপ্টকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন যুক্তরাজ্যও নয়, হ্যারল্ড উইলসনও নন বরং ওপেন ইউনিভার্সিটির লাইফ-লং লার্নিং বা জীবনব্যাপী শিক্ষা গ্রহণের ধারণাটি প্রথম আরব দেশের এক সম্ভ্রান্ত মরু-সন্তানের কাছ থেকে পাওয়া যায় যার নাম হযরত মুহম্মদ (সঃ)। তিনি শুধু সমস্ত মুসলিম নর-নারীর জন্য বিদ্যার্জন ফরজ- এ কথা বলেই ক্ষান্ত হননি বরং তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিদ্যা অর্জন করবার।
দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিদ্যা শিক্ষার যে হাদিসী নির্দেশনা রয়েছে সেটির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম ১৯৯২ তে। দেশে একটি শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি হাঁটি হাঁটি পা পা করে বত্রিশ বছরে পদার্পণ করেছে এবং ইতোমধ্যেই লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ই এ দেশের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যা এসএসসি থেকে পিএইচডি পর্যন্ত প্রোগ্রাম পরিচালনা করে। শিক্ষা লাভের বয়স, ধর্ম, বর্ণ এবং দূরত্ব কোনো বাধাই নয়- এমন বার্তা ইতোমধ্যেই জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র এমফিল এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম বাউবি’র গাজীপুর প্রধান ক্যাম্পাস থেকে পরিচালিত হয় এবং বাকি প্রায় ৬৫টি প্রোগ্রাম দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় বাংলাদেশের দূরবর্তী কোনো গ্রাম থেকেও শিক্ষাগ্রহণ এখন আর দুরূহ কোনো ব্যাপার নয়। নিজেকে একজন যোগ্য নাগরিক এবং একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছেই এখন বাউবি’র শিক্ষা লাভের সহজ সোপান।
বাউবি দিচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার এক অপূর্ব সুযোগ যা গ্রহণের জন্য খুব বেশি আর্থিক সক্ষমতার প্রয়োজন হয় না। বাউবি’র সিলেবাস এবং শিক্ষা-সামগ্রী প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদরা। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বাউবি’র এমবিএ/সিমপা/সিমবা প্রোগ্রামের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বইগুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। ডিস্ট্যান্স মোড বা দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান করা হলেও এখানে শিক্ষকদের সামনাসামনি বসে বা ফেস টু ফেস লার্নিং এর এক অনন্য সুযোগ রয়েছে, আর শিক্ষার্থীদের এ সুবিধা প্রদানের জন্যই দেশব্যাপী খোলা হয়েছে ১ হাজার ৫৬২ টি স্টাডি-সেন্টার।
বাউবি সব এলাকায়, সব শ্রেণির মানুষের জন্য শিক্ষা-সুবিধাকে সবার দোরগোড়ে পৌঁছে দেবার মত দুঃসাধ্য কাজটিকেই সাধ্যের মধ্যে আনতে সক্ষম হয়েছে। দূর্গম পার্বত্য অঞ্চলেও এখন বাউবি’র স্টাডি-সেন্টারগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে উপজাতি ও আদিবাসী শিক্ষার্থীদের হাতছানি দিচ্ছে শিক্ষার সুযোগ নেয়ার জন্য।
এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে উন্নয়নের অংশীদার হবার জন্য। বলা বাহুল্য, বাউবি’র সব স্টাডি-সেন্টারই সরকারি অথবা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যারা দেশের শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরিচালিত শিক্ষাক্রমে শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি বাউবি পরিচালিত প্রোগ্রামসমূহ পরিচালনা করে থাকে। ঐ সব সরকারি বা এমপিওভুক্ত স্কুল বা কলেজের শিক্ষকরাই(অনার্স ও মাস্টার্সের জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) ক্লাস পরিচালনা করেন, পরীক্ষা গ্রহণ করেন এবং উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন বাউবি’র বোর্ড অব গভর্নস এর নির্দেশনা অনুযায়ী এবং যৎসামান্য সম্মানী/পারিশ্রমিকের বিনিময়ে।
বাউবি’র সনদের মান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন তাই বিশেষভাবে স্মর্তব্য, বাউবি প্রদত্ত সার্টিফিকেট/সনদ সরকারি শিক্ষাবোর্ড প্রদত্ত সনদের সমমানের।
দেশের ঝরে পড়াসহ শিক্ষাবঞ্চিত বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত ও যোগ্য নাগরিক এবং দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করে মূলধারার সঙ্গে সংযুক্ত করবার যে বিশাল কর্মযজ্ঞ বাউবি হাতে নিয়েছে তাতে অন্যতম ভূমিকা রাখে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা স্টাডি-সেন্টারগুলো এবং শিক্ষাপ্রসারে সার্বিক কৃতিত্বের সিংহভাগের দাবিদার স্টাডি-সেন্টারসমূহের সম্মানিত সমন্বয়কারী ও টিউটররা যারা বাউবি নামক বিশাল দেহটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হন। বাউবি’র শিক্ষার গুণগত মান নির্ভর করে তাদেরই সদিচ্ছা এবং শিক্ষাপ্রদান সেবাকর্মের ওপর।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস এবং পরীক্ষাসমূহ সরকারি ছুটির দিন শুক্রবারে অনুষ্ঠিত হয় বিধায় সব পেশার কর্মজীবীরা এই শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। স্টাডি-সেন্টারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক/ কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা ছুটির দিনটিকে উপভোগ না করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে সেবার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
বিনিময়ে বাউবি থেকে যা আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে থাকেন তা নিতান্তই সামান্য, খুবই ক্ষুদ্র। অর্থ নয়, সেবাই এখানে মূখ্য। সেজন্য বাউবি তথা সমগ্র জাতি এই মহান সেবকদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু টিউটর সামান্যকিছু অবৈধ প্রাপ্তির লোভে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজের আত্মসম্মান, নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে বাউবি’র বদনাম রটিয়ে থাকেন যা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং খুবই দুঃখজনক।
এ কথা সত্য যে এ জাতীয় শিক্ষকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। গুটিকতক দুর্নীতিবাজ শিক্ষকের কারণে গোটা শিক্ষক জাতিকে দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। ২১ অক্টোবর বাউবি’র জন্ম দিবস আর এই দিনটিকে সামনে রেখে বাউবি’র নবনিযুক্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. ওবায়দুল ইসলাম বাউবি’র সকল প্রকার পরীক্ষা নকলমুক্ত করা, দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণসহ বাউবিতে কোয়ালিটি এডুকেশন বা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কাজেই বিরাজমান সমস্যার অতি দ্রুত সমাধান আসবে আশা করা যায়।
নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশের শিক্ষার ভূবনে আলোর দিশারী, অশিক্ষার অন্ধকার সাগরে হাবুডুবু খাওয়া জাতির উদ্ধারে এক সাহসী কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ—এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই।
২১ অক্টোবর, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে বাউবি নিতে যাচ্ছে শিক্ষিত এবং দক্ষ নাগরিক গড়ার এক নুতন শপথ। পৃথিবী যখন অন্ধকারে ঢাকা পড়বে, মানবকূল যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকবে, তখনও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আলোর প্রদীপ জ্বেলে জাতির শিয়রে জেগে রইবে ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করবার মহান প্রয়াসে। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড ইউনূসের সাড়া জাগানো আবিষ্কার ‘আ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস—জিরো পভার্টি, জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট এবং জিরো নেট কার্বন তত্ত্ব বাস্তবায়নে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই প্রথম এগিয়ে আসবে এবং নেতৃত্ব দেবে। আশা করা যায় অচিরেই বাউবি দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য একটি নুতন বার্তা নিয়ে, অনন্য আশীর্বাদ হিসেবে এক বিশেষ রূপে আবির্ভূত হবে।
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়