বাউবি টিউটরদের প্রশ্নবিদ্ধ নৈতিকতা

মো. নজরুল ইসলাম |

দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিদ্যা শিক্ষার যে নির্দেশনা রয়েছে সেটির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। ইতোমধ্যেই লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ই এ দেশের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যা এসএসসি থেকে পিএইচডি পর্যন্ত প্রোগ্রাম পরিচালনা করে। শিক্ষা লাভের বয়স, ধর্ম, বর্ণ এবং দূরত্ব কোনো বাধাই নয়-এমন বার্তা ইতোমধ্যেই জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। একমাত্র এমফিল এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম বাউবি’র গাজীপুর প্রধান ক্যাম্পাস থেকে পরিচালিত হয় এবং বাকি প্রায় ৬৫টি প্রোগ্রাম দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় বাংলাদেশের দূরবর্তী কোনো গ্রাম থেকেও শিক্ষা গ্রহণ এখন আর দুরূহ কোনো ব্যাপার নয়। নিজেকে একজন যোগ্য নাগরিক এবং একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছেই এখন বাউবি’র শিক্ষা লাভের সহজ সোপান।

বাউবি দিচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার এক অপূর্ব সুযোগ যা গ্রহণের জন্য খুব বেশি আর্থিক সক্ষমতার প্রয়োজন হয় না। বাউবি’র সিলেবাস এবং শিক্ষা-সামগ্রী প্রণয়ণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদরা। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বাউবি’র এমবিএ/সিমপা/সিমবা প্রোগ্রাম বিশ্বমানের এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বইগুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষা দেয়া হলেও এখানে শিক্ষকদের সামনাসামনি বসে বা ফেস টু ফেস লার্নিং এর এক অনন্য সুযোগ রয়েছে, আর শিক্ষার্থদের এ সুবিধা প্রদানের প্রদানের জন্যই দেশব্যাপী খোলা হয়েছে ১ হাজার ৫৬২ টি স্টাডি সেন্টার। ‘ঘর হতে শুধু দু পা ফেলিয়া’ এই বাক্যাংশটির সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছে বাউবি সব এলাকায়। সব শ্রেণির মানুষের জন্য শিক্ষা-সুবিধাকে সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলেও এখন বাউবি’র স্টাডি-সেন্টারগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে উপজাতি ও আদিবাসী শিক্ষার্থীদের হাতছানি দিচ্ছে শিক্ষার সুযোগ নেয়ার জন্য, এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে উন্নয়নের অংশীদার হবার জন্য। বলা বাহুল্য, বাউবি’র সব স্টাডি সেন্টারই সরকারি অথবা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যারা দেশের শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরিচালিত শিক্ষাক্রমে শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি বাউবি পরিচালিত প্রোগ্রামসমূহ পরিচালনা করে থাকেন। ওইসব সরকারি বা এমপিওভুক্ত স্কুল বা কলেজের শিক্ষকরাই (অনার্স ও মাস্টার্সের জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক)  ক্লাস পরিচালনা করেন, পরীক্ষা গ্রহণ করেন এবং উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন বাউবি’র নির্দেশনা অনুযায়ী এবং যৎসামান্য সম্মানী ও পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। বাউবি’র সনদের মান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু বাউবি’র সনদ সরকারি শিক্ষাবোর্ড প্রদত্ত সনদের সমমানের। 

দেশের ঝরে পড়াসহ শিক্ষাবঞ্চিত বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত ও যোগ্য নাগরিক এবং দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করে মূলধারার সঙ্গে সংযুক্ত করবার যে বিশাল কর্মযজ্ঞ বাউবি হাতে নিয়েছে তাতে অন্যতম ভূমিকা রাখে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা স্টাডি সেন্টারগুলো। শিক্ষা প্রসারে সার্বিক কৃতিত্বের সিংহভাগের দাবিদার স্টাডি সেন্টারসমূহের সম্মানিত সমন্বয়কারী ও টিউটররা, যারা বাউবি নামক বিশাল দেহটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হন। বাউবি’র শিক্ষার গুণগত মান নির্ভর করে তাদেরই সদিচ্ছা এবং শিক্ষাদান নামক সেবাকর্মের ওপর। সংশ্লিষ্ট স্কুল-কলেজের প্রধান অথবা তার নির্ধারিত কোনো সিনিয়র শিক্ষক স্টাডি সেন্টারের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন এবং তার সুপারিশের ভিত্তিতে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিকটতম যোগ্যতা সাপেক্ষে টিউটর নির্বাচিত হন। 

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস এবং পরীক্ষাসমূহ সরকারি ছুটির দিন শুক্রবারে অনুষ্ঠিত হওয়ায় সব পেশার কর্মজীবীরা এই শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। স্টাডি সেন্টারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা ছুটির দিনটিকে উপভোগ না করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে সেবার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বিনিময়ে বাউবি থেকে যা আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে থাকেন তা নিতান্তই সামান্য, খুবই ক্ষুদ্র। অর্থ নয়, সেবাই এখানে মুখ্য। সে জন্য বাউবি তথা সমগ্র জাতি এই মহান সেবকদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু মানুষ মাত্রেই লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে নয় এটা মানতেই হবে। সমাজে কিছু মানুষ আছে যারা সামান্য প্রাপ্তির লোভে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে আত্মসম্মান, নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। সম্মানিত টিউটররা জাতি গঠনের মহান ব্রত নিয়ে নিঃস্বার্থ সেবা দান করে গেলেও প্রায়শই কিছু প্রতিষ্ঠানে ব্যতিক্রমধর্মী কিছু শিক্ষকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় যাদের অনৈতিকতার দায়ভার বহন করতে হয় সমগ্র শিক্ষক জাতিকে। দুর্নীতি ও চারিত্রিক স্খলন যে শিক্ষক সম্প্রদায়ের মধ্যেও উপস্থিত তা দীর্ঘ চাকরিজীবনে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশ কয়েকবারই প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে  এ প্রতিবেদনকারীর। বিভিন্ন স্টাডি সেন্টার এবং পরীক্ষাকেন্দ্র পরিদর্শন করে যেমন কিছু সুখকর অনুভূতি হয়েছে তেমনই তিক্ত অভিজ্ঞতালাভের পরিমাণও নেহাত কম নয়। কোনো কোনো পরীক্ষাকেন্দ্রে দেখা গেছে পর্যাপ্ত কক্ষ থাকা সত্ত্বেও একটি কক্ষে গাদাগাদি করে পরীক্ষার্থীদের বসান হয়েছে যাতে খুব সহজেই তারা একে অপরের দেখে দেখে লেখার সুযোগ পায়। পরিদর্শকের সামনেই পরীক্ষার্থী নকল অথবা বই বের করে লিখছে অথচ পরিদর্শক তা দেখেও না দেখার ভান করে তাকে অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ করে দিচ্ছেন, বাউবি’র বিশেষ পরিদর্শক সেখানে উপস্থিত হলে কক্ষে দায়িত্বরত পরিদর্শকরা হাঁচি-কাশি বা অন্য কোনো সংকেত দিয়ে পরীক্ষার্থীদের সতর্ক করে দেয়ার ঘটনা যেনো একটা স্টাইলে পরিণত হয়ে গেছে এক শ্রেণির শিক্ষকের। আবার এও দেখা গেছে কিছু শিক্ষক পরীক্ষাকক্ষে বিশেষ সুবিধা প্রদানের অঙ্গীকারে পূর্বাহ্নেই পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করে বসে আছেন অর্থাৎ পরীক্ষাসংক্রান্ত যতোরকম দুর্নীতির পথ আছে সবটাতেই পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকের একটা গোপন আঁতাত বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই দুর্নীতিবাজ শিক্ষকরাই আবার বাইরে গিয়ে বাউবি’র শিক্ষার মান নিয়ে বদনাম করে বেড়ান, বাউবি’র শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অথচ তাদের দায়িত্ব ছিলো রুটিন অনুযায়ী নিয়মিত ক্লাস নেয়া, যদিও ক্লাস না নিয়েই অনেকে বিল তৈরি করে বাউবিতে প্রেরণ করেন, সুষ্ঠুভাবে নকলমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা গ্রহণ করা এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা যার কোনো দায়িত্বই সঠিকভাবে পালন না করে বাউবি’র দেয়া সম্মানী নিয়ে বাইরে আবার বাউবি’রই বদনাম বরেন। এ কথা সত্য যে এ জাতীয় শিক্ষকের সংখ্যা খুবই নগণ্য তবে একেবারেই বিরল নয়। গুটিকয়েক শিক্ষকের কারণে গোটা শিক্ষক জাতিকে দায়ভার বহন করার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক, এতে প্রকৃত শিক্ষকদের মন বিষিয়ে ওঠে এই পেশার প্রতি। প্রশ্ন উঠতে পারে বাউবি তবে এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেনো? হ্যাঁ, বাউবি’র সীমাবদ্ধতা আছে, বাউবি এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নয়, এদের ওপর বাউবি খবরদারি করতে পারে না, শুধু প্রয়োজনে ওই অভিযুক্ত স্টাডি সেন্টার বাতিল করতে পারে এবং তদস্থলে অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে স্টাডি সেন্টার হিসেবে ঘোষণা করতে পারে এবং তা করেও। কিন্তু সমস্যার বীজ সব জায়গাতেই লুকিয়ে আছে, সব সরষে ক্ষেতেই ভূতের বাস, অবাধ বিচরণ। আবার এদের অনেকের পেছনে আছে রাজনৈতিক শক্তি। বাউবি’র নিজস্ব কোনো কর্মচারী এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ও প্রমাণ পেলে বাউবি কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো কার্পণ্য করে না কিন্তু স্টাডি সেন্টারগুলোর ওপর বাউবি’র ক্ষমতা খুব সামান্যই। আর সে জন্যই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে বাউবিকে আরো কিছুটা পথ হাঁটতে হবে বলেই অনুমিত হয় যতোক্ষণ না কথিত টিউটরদের নৈতিক চরিত্রের উন্নতি হয়। আশা করা যায় অচিরেই বর্ণিত টিউটরদের বোধোদয় হবে, নিজেদের আত্মমর্যাদা ও নৈতিকতা জাগ্রত হবে এবং তারা জাতির কল্যাণের কথা বিবেচনা করে বাউবি’র লক্ষ্য অর্জনে সহগামী হবেন।    

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।                 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025949478149414