২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষায় প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ থাকছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা চলমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিলো ৪২ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা ও ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
আমরা জানি, শিক্ষা বাজেটের একটি অংশ ব্যয় হয় শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও ঋণ দেয়ায় এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায়। এ ছাড়া আরেকটি অংশ ব্যয় হয় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার, সৌন্দর্যবর্ধন ও নির্মাণকাজে। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর দিকনির্দেশনা সেখানে উপেক্ষিত থাকে। অনেকটা ঢাল ও তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দারের মতো। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, বিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলক পাঠদান চলমান। চলমান শিক্ষা বিস্তরনে প্রাক, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে কোনো চূড়ান্ত মুল্যায়ন গ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না, তবে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মুল্যায়ন চলবে।
শিক্ষানীতি হলো একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আদর্শ, নীতিমালা, কাঠামো, পরিচালনা ও মূল্যায়নের একটি সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত রূপরেখা। এটি একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্ধারণ করে। শিক্ষানীতির প্রধান উদ্দেশ্য দেশের জনগণের বা শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়ন ঘটানো।
শিক্ষাক্রম হলো সুনির্দিষ্ট কয়েকটি লক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রণীত শিখন অভিজ্ঞতা, পঠন-পাঠন সামগ্রী এবং শিক্ষাদান কার্যাবলির সমন্বিত রূপরেখা যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও বাঞ্চিত পরিবর্তন আনার মাধ্যমে শিক্ষার পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হয়। শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য শিক্ষার্থীর সামগ্রিক জীবনের বিকাশ সাধন।
শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার্থীদের জন্য স্থাপিত পাঠ্যক্রম, কোর্স বা কোর্সগুলোর সমন্বয় সম্পর্কে উপস্থাপন করে। শিক্ষাক্রম বিস্তারের লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট শিক্ষাগত লক্ষ্য সম্পন্ন করা। এটি কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষার স্তর অনুযায়ী উন্নয়ন করা হয়ে থাকে। চলমান শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে যেয়ে শিক্ষার সামগ্রিক বিস্তরন ও মুল্যায়ন ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাই তো বিশাল এই শিক্ষক সমাজ খেই হারিয়ে ফেলেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষার ভিত রচনা করে, যা সবার জীবনব্যাপী প্রক্রিয়মান। কিন্তু সেই জায়গায় আমরা অত্যন্ত নাজুক। প্রাথমিক শিক্ষাক্রমকে আরো অংশগ্রহণমূলক করার জন্য প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি সংযোজন করা হয়েছিলো। কিন্তু আমরা কি এখানে সফল হতে পেরেছি? প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিশুকে কি সঠিকভাবে বিকাশে সহায়তা করতে পেরেছি? প্রাথমিক শিক্ষায় বিভিন্ন ধরনের শিক্ষক আছেন। কাউকে খাটো না করে বলছি, এইচএসসি, ডিগ্রি (পাস), স্নাতক, স্নাতকোত্তর পাস করা শিক্ষক আছেন। পরিবর্তনের এই ধারাবাহিকতায় সবাই কি সমানভাবে এটা গ্রহণ করতে পারছে। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সবাই বোঝেন না, বা বুঝতে চান না। শিক্ষক তখনই সঠিকভাবে মুল্যায়িত হবেন, যখন সব শিশু বলবেন স্যার খুব ভালো।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুকে শ্রেণিকক্ষে কোনো প্রশ্ন করলে বলতে পারে না। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন কিছু শিশু বোঝে কিন্তু বলতে পারে না, আবার কিছু শিশু আছে বোঝে না কিন্তু বলতে পারে, অন্যদিকে অনেকে আছে বোঝে না আবার বলতে পারে না। এখানে শিশুর কোনো দোষ নেই। দুর্বলতা হচ্ছে আমাদের শেখানোর কৌশলের। আর এই কৌশলকে আয়ত্ব করে নিজেকে বুঝদার শিশুর গুরু হিসেবে তৈরি করতে হলে দরকার প্রশিক্ষণ আর নিজের আগ্রহ। যদি এই দুটির সমন্বয় হয় তবেই শিশু শিখবেন।
আমরা শ্রেণিকক্ষ সুসজ্জিত করে রাখার বা সুসজ্জার ব্যাপারে খুব আগ্রহী। সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষে যদি শিশুকে ধরে রাখার মতো কৌশল না জানি তাহলে আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। বছরে গুনে গুনে ৩ দিন বা ৭ দিনের প্রশিক্ষণ হলে চলবে না। ক্লাস্টার ভাগ করে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার ৮ শত ১৯ দশমিক ৫২ কোটি টাকা। তার মধ্যে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ হাজার ৬ শত ৮৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ, উন্নয়ন ব্যয় ১৬ হাজার ১ শত ৩৫ দশমিক ৫২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩২ দশমিক ৬২ শতাংশ। তবে উন্নয়নের ৪ হাজার ৯০৩ দশমিক ৮২ কোটি আসবে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে, যা বাজেটের ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। বাস্তবায়ন ও মনিটরিং সেলের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৫ দশমিক ১১ কোটি টাকা যার শতকরা হার দশমিক ১১। অন্যদিকে, গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে দশমিক ১০ কোটি টাকা । বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে উন্নয়নের জন্য ৪ হাজার ৯ শত ৩ দশমিক ৮২ কোটি যদি বাদ দিই তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ থাকে ১৯ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা যার তিনগুণ ব্যয় হচ্ছে পরিচালন ব্যয় তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের জন্য গলা ভাটিয়ে লাভ কী? আবার শিক্ষকের পেছনে ভিমরুলের মতো লেগে শিখন-শিক্ষণ উন্নয়ন কি আদৌ সম্ভব?
বিভিন্ন দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাগুলো প্রাথমিক শিক্ষার দুরবস্থা অনুধাবন করছে। সেজন্য তারা প্রাথমিকের শিশুদের পঠন, লিখন ও বলনের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আর আমাদের বাজেটে উন্নয়ন বরাদ্দের লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, বিনামুল্যে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণ ৪ শত ৪৭ দশমিক ১০ কোটি টাকা, আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ১ হাজার ৭ শত ৮৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে, উপজেলা শিক্ষা অফিস বাবদ বরাদ্দ প্রস্তাবিত হয়েছে ৩ শত ৩০ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। বিনামুল্যে পাঠ্যপুস্তক আর উপবৃত্তি দিয়ে কিন্তু মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত সম্ভব নয়। আজ পর্যন্ত কোথাও শুনিনি কোনো উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শ্রেণিকক্ষে যেয়ে নতুন কোনো বিষয়ে শিশুদের আন্দোলিত করার মতো কাজ করেছেন।
প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। পরীক্ষা নেই তো পড়াশোনাও নেই। কিন্ডারগার্টেনে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘খাতা কলম পেন্সিল আমাদের, পড়ালেখা আপনাদের’। প্রাথমিক শিক্ষা যদি বই আর উপবৃত্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয় কিন্ডারগার্টেন হয়ে যাবে!
বাস্তবের সঙ্গে মিল রেখে বাজেটে মনিটরিং ব্যবস্থাকে সেলের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। তাইতো বলা হচ্ছে বাস্তবায়ন ও মনিটরিং সেল। পরিবীক্ষণ, নিরীক্ষণ, পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ নিয়ে কথা সমীচীন মনে করছি না। বাজেটে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে গবেষণা বা উদ্ভাবনী কার্যক্রম গতানুগতিক। কতৃপক্ষ মনে করছে, এখানে নতুন কোনো কিছু করা যাবে না। যে যখন যেটা মনে করবে সেটা হবে। প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। আছে শুধু ধারাবাহিক মুল্যায়ন। প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, প্রথম শ্রেণিতে, ৩২ লাখ ৫০ হাজার ২৫১ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে, ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩১৮ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৩৩ লাখ ৫৭ হাজার ৫২ জন। আর প্রি-প্রাইমারিতে ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ৫ জন। প্রি-প্রাইমারি শিশুর কথা বাদ দিলাম। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিশু আছেন ১ কোটি ২ লাখ ৫ হাজার ৬২১ জন, যা মোট শিশুর ৬০ দশমিক ১৬ শতাংশ। এবার বোঝা দরকার গবেষণা বা উদ্ভাবন আমাদের দরকার আছে কি না। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। আমরা যদি ব্যর্থ হই তাহলে এই সংখ্যাটা বেশি ছাড়া কম হবে না। স্কুলে যদি যথার্থ লেখা পড়া না হয় তাহলে অভিভাবক নিশ্চয়ই বসে থাকবেন না। শিশুর জন্য ভিন্ন কোনো পথ বেচে নিতে বাধ্য হবেন। আর হচ্ছেও তাই।
প্রাথমিকে পরিবারের জন্য প্রতি শিশুর বার্ষিক শিক্ষার ব্যয় ২০২২ থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক স্তরে ২৫ শতাংশ। তার মানে হচ্ছে, পারিবারিক শিক্ষা ব্যয় বেড়েই চলেছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের ব্যয় ও পুরোটা শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংষ্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শিক্ষা খাতে ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করছে পরিবার। এটা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় বেশি, যা আমাদের শিশুর শিক্ষা ও অধিকারের জন্য হুমকি।
তাই আমাদের উচিত প্রাথমিক শিক্ষায় পর্যাপ্ত গবেষণা ও মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করা। আর এটা হলে আমাদের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনে প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
লেখক: শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থায় কর্মরত