বাড়ছে উন্নতি কমছে দেশপ্রেম

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

নির্মম সত্যটা হলো, যতই উন্নতি ঘটছে ততই কমছে দেশপ্রেম। তাই বলে দেশপ্রেম কী একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে? না, মোটেই নয়। দেশপ্রেম অবশ্যই আছে। বিশেষভাবে আছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধ্যে। তারা অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করবে, এমনটা ভাবতেই পারে না। বেশিরভাগই দেশে থাকে। পরিশ্রম করে এবং তাদের শ্রমের কারণেই দেশের যেটুকু উন্নতি তা সম্ভব হয়েছে। ভোক্তারা নয়, মেহনতিরাই হচ্ছে উন্নতির চাবিকাঠি। ঋণ করে, জায়গাজমি বেচে দিয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের কেউ কেউ বিদেশে যায়; থাকার জন্য নয়, উপার্জন করে টাকা দেশে পাঠাবে বলে। বিদেশে গিয়ে অনেকেই অমানবিক জীবনযাপন করে, ‘অবৈধ’ পথে গিয়ে এবং প্রতারকদের কবলে পড়ে কেউ কেউ জেল পর্যন্ত খাটে। কিন্তু তারা বুক বাঁধে এই আশাতে যে, দেশে তাদের আপনজনরা খেয়েপরে বাঁচতে পারবে।

বিত্তবানরা যা ছড়ায়, তা হলো হতাশা। এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এটাই তাদের স্থির বিশ্বাস। হতাশা কিন্তু তারাই সৃষ্টি করে। বিশেষভাবে করে সম্পদ পাচার করার মধ্য দিয়ে। এই যে দেশে এখন ডলার সংকট চলছে এবং যার ফলে সবকিছুর দাম বেড়েছে, তার প্রধান কারণ টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটা বিত্তবানদের কাজ। তারাই হতাশা সৃষ্টি করে এবং দেশের ভবিষ্যৎহীনতার বিশ্বাস ক্রমাগত বলীয়ান হতে থাকে। এবং নিজেদের ওই হতাশা তারা যে কেবল নিজেদের মধ্যেই আটকে রাখে তা নয়, অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত করে দেয়। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ হতাশা হচ্ছে একটি রোগ। শুধু রোগ নয়, সংক্রামক রোগ বটে। একাত্তরে যখন আমরা চরমতম বিপদের মধ্যে ছিলাম, মৃত্যুর শঙ্কায় দিবারাত্র সন্ত্রস্ত থাকতাম, তখন অমন চরমতম বিপদ ও সীমাহীন অত্যাচারের মুখেও, আমরা কিন্তু হতাশ হইনি; কারণ আমরা জানতাম, আমরা কেউ একা নই, আমরা সবাই আছি একসঙ্গে এবং লড়ছি একত্র হয়ে। ষোলোই ডিসেম্বরেই কিন্তু সেই ঐক্যটা ভাঙবার লক্ষণ দেখা দিয়েছে; এবং কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে একেবারে খান খান হয়ে গেছে। সমষ্টি হারিয়ে গেছে, সত্য হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে উন্নতি করা, না পারলে কোনোমতে বেঁচে থাকা।  বুধবার (৫ জুন) দেশ রূপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

নিবন্ধে আরো জানা যায়, এমনটা কেন ঘটল? ঘটল এই কারণে যে, উত্থান ঘটল লুণ্ঠনের, জবরদখলের, ব্যক্তিগত সুবিধা বৃদ্ধির। এবং এসবই প্রধান সত্য হয়ে দাঁড়াল। একাত্তরে আমরা সমাজতন্ত্রী হয়েছিলাম, বাহাত্তরে দেখা গেল সমাজতন্ত্র বিদায় নিচ্ছে, পুঁজিবাদ এসে গেছে। এবং পুঁজিবাদেরই অব্যাহত বিকাশ ঘটেছে এই বাংলাদেশে। দেখা গেছে, পরের সরকার আগেরটির তুলনায় অধিক মাত্রায় পুঁজিবাদী এবং একই সরকার যদি টিকে থাকে, তবে আগের বারের তুলনায় পরের বার পুঁজিবাদের জন্য অধিকতর ছাড় দিচ্ছে। পুঁজিবাদের বিকাশের প্রয়োজনে, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার জন্য আমরা যুদ্ধ করিনি; পুঁজিবাদের বিকাশ তো পাকিস্তান আমলে বেশ গোছগাছ করেই এগোচ্ছিল। আমরা চেয়েছিলাম, সবার মুক্তি; চেয়েছিলাম প্রত্যেকেই যাতে মুক্তি পায়।

দেশের মানুষ বিদেশে শিক্ষার জন্য যেমন যায় তেমনি যায় চিকিৎসার জন্যও। বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসকের কি অভাব আছে? আধুনিক যন্ত্রপাতি কি নেই? আকাল পড়েছে কি চিকিৎসা বিষয়ে জ্ঞানের? না, অভাব এসবের কোনো কিছুরই নয়। অভাব ঘটেছে একটা জিনিসেরই, সেটা হলো আস্থা। রোগী আস্থা রাখতে অসমর্থ হয়, দেশি চিকিৎসকের চিকিৎসায়। তাই যাদের সামর্থ্য আছে তারা পারলে সিঙ্গাপুরে বা ব্যাংককে যায়, অত খরচে যারা অপারগ তারা চেষ্টা করে ভারতে যাওয়ার। এবং হতাশা যেমন, অনাস্থাও তেমনি ভীষণ রকমের সংক্রামক। আস্থার এই অভাবের কারণটা কী? কারণ হচ্ছে দেশি চিকিৎসকদের অধিকাংশই রোগীকে সময় দিতে পারেন না, পর্যাপ্ত মনোযোগ দানেও ব্যর্থ হন। না দিতে পারার কারণ তাদের তাড়া করার জন্য ঘাড়ের ওপর বসে থাকে অর্থোপাজনের নিষ্ঠুর তাগিদ। যত বেশি রোগী দেখবেন তত বেশি আয় হবে। রোগ সারানোর জন্য খ্যাত হওয়ার চেয়ে আগ্রহটা থাকে অপরের তুলনায় অধিক আয় করার দিকে। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেখলাম, আস্থার এই অভাবের কথাটা স্বীকার করেছেন। কিন্তু আস্থা কীভাবে ফেরত আনা যাবে, তা যে তিনি জানেন এমনটা ভরসা করা কঠিন। আর জানলেও তা কার্যকর করার উপায় তার হাতে না থাকারই কথা। কারণ ব্যাপারটা একজন-দুজন চিকিৎসকের নয়, ব্যাপারটা এমনকি চিকিৎসাব্যবস্থাতেও সীমাবদ্ধ নয়, এটি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা জুড়ে। সর্বত্রই আস্থাহীনতা বিরাজমান।  শুরুটা কিন্তু দেশের ভবিষ্যতের প্রতি আস্থার অভাব দিয়েই। সুবিধাপ্রাপ্ত লোকেরা মনে করে যে, এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই অন্যত্র বসতি গড়তে পারলে ভালো। সেই চেষ্টাই তারা করতে থাকে। এবং চেষ্টার অংশ হিসেবে বৈধ-অবৈধ যে পথেই সম্ভব টাকাপয়সা যা সংগ্রহ করতে পারে তা পাচার করার পথ খোঁজে। তাদের এই আস্থাহীনতা অন্যদের মধ্যেও অতিসহজেই সংক্রমিত হয়ে যায় এবং সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছেও।

রাষ্ট্র আছে। কিন্তু রাষ্ট্র যে মানুষকে নিরাপত্তা দেবে এমন কোনো ভরসা নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়। অন্যসব কিছু বাদ থাক, রাস্তার ট্রাফিক বাতিগুলোকে যে ঠিকমতো কাজ করাবে তাও তো পারছে না। সারা বিশ্বে এমন কোনো বড় শহর আছে বলে আমাদের জানা নেই, যেখানে ট্রাফিক সিগনাল যানচলাচল নিয়ন্ত্রণে অসমর্থ।  ঢাকা শহরে ট্রাফিক বাতি আছে, কিন্তু সেগুলোর কোনো কার্যকারিতা নেই। নির্ভরতা ট্রাফিক পুলিশের ওপর। ওদিকে খোদ পুলিশ বাহিনীর ভেতর দুর্নীতি আগেও ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে সেটা কমছে না, ক্রমাগত বাড়ছেই। নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। বিপন্ন হয়ে আদালতে গেলে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। আদালতে গিয়ে মামলা করাটাই মস্ত বড় বিড়ম্বনা। টাকা লাগে। সময় খরচ হয়। একবার ঢুকলে সহজে বের হয়ে আসা যায় না, মামলা চলতেই থাকে; এর মধ্যে টাকার আদান-প্রদানে বিরাম ঘটে না। নিম্ন আদালতে বিচার কেনাবেচা সম্ভব এমন গুঞ্জন আদালত পাড়াতেই শোনা যায়। রাষ্ট্রের চলমানতার আসল চাবিকাঠি আমলাদের হাতে। ব্যবসায়ীরাই যে রাজনীতিকে কব্জায় রাখে এটা ঠিক, কিন্তু তাদেরও দ্বারস্থ হতে হয়, চাবিকাঠি যাদের হাতে তাদের কাছে (অর্থাৎ আমলাদের)। রাষ্ট্রের চরিত্রটা তাই দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক। আমলারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ব্যাপারেই মনোযোগী, পাবলিকের উপকারের ব্যাপারে নয়। পাবলিক সার্ভেন্টদের কেউ পাবলিকের সেবা করার জন্য রওনা দিয়েছে, এমন খবর পেলে পাবলিকের মনে স্বস্তি আসবে কি, আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পুলিশের এসপিরা নাকি বিনা সুদে ঋণের দাবি জানিয়েছেন; আর নিচের দিকে যারা রয়েছেন, তাদের দাবি ভাতা বৃদ্ধি। সিভিল সার্ভিস অত সুবিধা পেলে পুলিশ সার্ভিস কেন পিছিয়ে থাকবে? বিশেষ করে নির্বাচনের সময়ে যখন তাদের কাজ অমন জরুরি হয়ে পড়ে? সামরিক বাহিনীর সুযোগ-সুবিধার বিষয়টা অবশ্য জানাজানি হয় না, তবে সরকারের অন্যান্য শাখার লোকেরা নিশ্চয়ই খোঁজখবর কিছু রাখে, এবং নিজেদের বঞ্চিত ভেবে ক্ষুব্ধ হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা অবশ্য রাষ্ট্রক্ষমতা কাদের কর্তৃত্বাধীন থাকবে সেই প্রশ্নের মীমাংসা। মীমাংসার বিদ্যমান উপায়টা হচ্ছে নির্বাচন। তা নির্বাচন তো হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী যা জাজ¦ল্যমান তাহলো প্রতিক্রিয়াশীলরাই সদম্ভে নির্বাচনে জিতে আসছে। তার কারণ প্রতিক্রিয়াশীলরা ক্ষমতাবান; তাদের হাতে টাকা আছে। দাতব্য প্রতিষ্ঠান অক্সফ্যাম খবর দিচ্ছে যে, ২০২০ সালের পর বিশ্বব্যাপী ধনীদের সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুণ। মিডিয়ার মালিকও তারাই এবং বিরোধীরা যে বিকল্প একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দেবে, সে কাজে অপারগ হচ্ছে। মোট কথা, বুর্জোয়াদের শাসনাধীনে বুর্জোয়ারাই তো জিতবে। জিতছে তারাই। তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে ঠিকই, কিন্তু জনগণকে শোষণ ও বঞ্চিত করার যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, সেটাকে রক্ষা করার ব্যাপারে তারা একমত। তলে তলে নয়, প্রকাশ্যেই। সবকিছু মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, বুর্জোয়াদের জোর অনেক বেশি, ফলে যারা রাষ্ট্রকে আরও অধিক ফ্যাসিবাদী করে তোলার জন্য মরিয়া তারাই শাসনক্ষমতা পাচ্ছে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর - dainik shiksha শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী - dainik shiksha আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই - dainik shiksha প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে - dainik shiksha জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ - dainik shiksha বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য - dainik shiksha এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা - dainik shiksha অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর - dainik shiksha ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন - dainik shiksha বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী - dainik shiksha একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029919147491455