বিএড কলেজ বাতিল ও আমাদের করণীয়

মাছুম বিল্লাহ |

শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা এবং ব্যবসা করতে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার ঘটনা অনেক দেশেই ঘটে থাকে। তবে, প্রেক্ষাপট ভিন্ন এবং এর পেছনের কারণগুলোও কিছুটা আলাদা ও অনেক দেশে এর প্রতিকারও আছে। সম্প্রতি সপ্তাহে ব্রুনাই দারুসসালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (আন্তর্জাতিক মাইগ্রেশন বিশেষজ্ঞ) ড. আহসান উল্লাহর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি জানালেন, লন্ডনের এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য তিনি যখন ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, তিনি এশিয়া থেকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নিয়ে আসতে পারবেন কিনা। উনি সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, এটি তার কাজ নয়। তিনি তারপর আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব কায়রোতে শিক্ষকতা করেন। এটিও কি শিক্ষা ব্যবসার নমুনা নয়? আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি একটি ঘটনা ঘটেছে- যা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

প্রথমে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আমাদের মতো প্রায় সতেরো কোটি মানুষের দেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যা সরকারি ১৪টি আর বেসরকারি পর্যায়ে ১২০টি। অথচ পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সাড়ে দশ কোটি লোকের জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় সরকারি পর্যায়ে রয়েছে ২৪টি, আর বেসরকারি ৬২৪টি। সেগুলোর মধ্যে সম্প্রতি ২৫৩টি বেসরকারি প্রশিক্ষণ কলেজের অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে। দৈনিক আমাদের বার্তায় এ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

কীভাবে সেগুলোর অনুমোদন বাতিল হলো, কে করলো এবং কেনো করা হলো-এগুলো আমাদের দেশের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ তথা কর্তৃপক্ষের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়।

পশ্চিমবঙ্গে জুলাই থেকে কলেজগুলোতে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়। কলেজগুলো আগে অফলাইনে শিক্ষার্থী ভর্তি করে। পরে অনলাইনে ভর্তির লিঙ্ক খুললে সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কিন্তু একাধিক অনিয়মের অভিযোগে নভেম্বর মাসে রাজ্যের ২৫৩টি বেসরকারি বিএড কলেজের অনুমোদন বাতিল করা হয়। কে বাতিল করেছে? রাজ্যের বিএড বিশ্ববিদ্যালয়। এটি আমাদের জন্য একটি বিশাল শিক্ষণীয় বিষয়। দশ কোটি ২৫ লাখ জনসংখ্যার রাজ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে বিএড বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ আমাদের সতেরো কোটি জনসংখ্যার দেশে বিএড বিশ্ববিদ্যালয় বলে কিছু নেই। সব কলেজ গড় পরতায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। এ ধরনের বিশেষায়িত কলেজগুলো দেখার জন্য বিশেষায়িত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি।

দৈনিক আমাদের বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাছ্ছে, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, শিক্ষকদের বেতনের নথিতে অসঙ্গতি এবং দমকলের ছাড়পত্র না মেলার মতো অভিযোগ থাকায় বিএড বিশ্ববিদ্যালয় ওই সব কলেজের অনুমোদন বাতিল করেছে।

এনসিটিই (ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার্স এডুকেশন)-এর নিয়ম অনুযায়ী, একটি বিএড কলেজে ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য আট জন শিক্ষক রাখতে হবে এবং প্রতি শিক্ষকের মাসিক বেতন হবে ২১ হাজার ৬০০ টাকা। আর দমকলের ছাড়পত্র পেতে প্রতিটি কলেজের ছাদে ন্যূনতম ১০ হাজার লিটারের পানির ট্যাংক বসাতে হবে। কলেজে রাখতে হবে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প। এ ছাড়া কলেজের সামনে একটি জলাধার রাখতেই হবে।

এখান থেকে আমাদের শেখার বিষয় কী কী আছে? আমাদের দেশের সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোতেও কি এ ধরনের ব্যবস্থা হয়েছে? বেসরকারিগুলোর বেহাল অবস্থা আমরা প্রায় সবাই জানি। কোথায় পানির ট্যাংক আর কোথায় জলাধার? আর ক’জন শিক্ষক ক’জন প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই, খোঁজ নেয়ার মতো সে রকম অথরিটিও নেই বলা যায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এগুলো কতোটা কি দেখে সে বিষয়টিও আমাদের অজানা নয়। আর পশ্চিমবঙ্গের বিএড বিশ্ববিদ্যালয় যে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে, এ উদাহরণও আমাদের দেশে কম।

বাংলাদেশের বেসরকারি বিএড কলেজগুলো বাণিজ্যিক প্রশিক্ষণ ও অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষকদের সনদ প্রদান করছে এ ধরনের অভিযোগও পুরোনো। সহজ সুযোগ হওয়ায় সরকারি কলেজগুলোতে না গিয়ে বেসরকারি কলেজ থেকে বিএড সনদ নেন শিক্ষকরা। এতে সরকারি কলেজগুলো প্রশিক্ষণার্থী পায় না। এই অনিয়ম বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একাধিকবার উদ্যোগ নেয়, কিন্তু তাতে কাজ হয়েছে খুবই কম। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে নানা অনিয়মের কারণে কয়েকটি বিএড কলেজকে লাল, কয়েকটিকে ধূসর ও কয়েকটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেয় যে, সরকারি টিটি কলেজ ছাড়া কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিএড সনদধারীদের স্কেল দেয়া হবে না। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে এসব কলেজের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে তারা কার্যক্রম চালিয়ে যায়।

এরপর রিট, রুলসহ নানা ঘটনার পর কোনো বেসরকারি টিটিসি সনদের বিপরীতে বিএড স্কেল না দেয়ার যে সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়েছিল সেটি মন্ত্রণালয়ের ওপর ছেড়ে দেয় আদালত।

২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে টিটিসিগুলোর মধ্যে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং মে মাসে মাউশি অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক দূর্গা রানী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন করে ২৩টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের বাইরেও অন্য টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে অর্জিত সনদের বিপরীতে বিএড স্কেল দেয়া হচ্ছে। এতে সরকারের বড় অঙ্কের অর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এই অবস্থায় ২৩ কলেজের বাইরে অন্য কলেজগুলোর সনদ গ্রহণ না করতে মাউশির সকল আঞ্চলিক উপ-পরিচালক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের ও অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশ দেয়া হয়।

সর্বশেষ সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পাশাপাশি মাত্র ২৩টি বেসরকারি টিটি কলেজ থেকে বিএড সনদ অর্জনকারীরা উচ্চতর স্কেল পাবেন বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। ভুয়া বিএড সনদ নিয়ে উচ্চতর স্কেল প্রাপ্তির বিষয়টি তদন্ত করতে ডিআইএর একটি টিম ঢাকার অন্যতম নামকরা প্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে জানতে পারে, সেখানে ৪৩ জন শিক্ষক বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড সনদ নিয়ে উচ্চতর স্কেল গ্রহণ করছেন।

এখানে একটি দৃশ্যমান বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ সরকারি ও বেসরকারি--দুটো পর্যায়েই বাস্তবতার নিরিখে গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে এবং পশ্চিমবঙ্গেও। পৃথিবীর অনেকে দেশেই এই বাস্তবতা বিদ্যমান। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেই হবে, তা না হলে নবীন শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কী পড়াবেন, কীভাবে পড়াবেন? তারা নিজেরাই তো শিক্ষার্থী! শ্রেণিকক্ষ থেকে এসে আর একটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গভীর মনোনিবেশ ছাড়া কখনো সার্থকতা লাভ করে না। তাই আমাদের সব শিক্ষক এবং যারা শিক্ষক হতে আগ্রহী তাদের সবাইকেই এ জাতীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সেটি কীভাবে মানসম্মত হবে সে বিষয়টির সুরাহা হয়নি। মানসিকতা এমন, প্রশিক্ষণ নিতে হবে তাই প্রশিক্ষণ নিলাম কারণ বেতন স্কেল বেড়ে যাবে। আর এই কারণেই গড়ে উঠেছে বেসরকারি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়। আমরা এগুলোর অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারবো না।

কোচিং সেন্টার টাইপ, মার্কেটের দোতলায় বা চিপা গলির ভেতর শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় যাতে প্রতিষ্ঠিত না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে দৃষ্টি দিতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য সরকারি, বেসরকারি প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। শুধু আইন করে বসে থাকলেই চলবে না- এ মহাবিদ্যালয়গুলো কীভাবে চলছে, এগুলো আরো কীভাবে ভালো করা যায়, এগুলোর কার্যাবলী সঠিক পথে কতোটা আছে তা দেখার জন্য বিশেষজ্ঞ টিম থাকা প্রয়োজন।

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002187967300415