বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তার প্রজাতন্ত্রের বিচারশক্তি ও জনগণের অধিকার, আইনবিষয়ক বইয়ে লিখেছেন, কোনো বিচারকই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। সভ্য জগতে ভব্য সমালোচনার একটা অবকাশ রয়েছে। বিচারকের রায়ের সমালোচনা করার অধিকার বাক স্বাধীনতার অংশ। আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সংবিধানে এই বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান তার একটি বইয়ে লিখেছেন, বিচারকদের কর্মকাণ্ড ও তাদের আচরণের ওপর নজর রাখার ক্ষেত্রে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে থাকে। সংবাদপত্র বিচারকদের কর্মকাণ্ডের সতর্ক প্রহরী (ওয়াচ ডগ)। বিচারকরাও মানুষ এবং এ কারণেই তারা ভুলের ঊর্ধ্বে নন। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরাও রায় প্রদানে ভুল করতে পারেন। সে দিক থেকে একজন বিচারক আন্তরিক ও ন্যায়সংগত সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন।
মানুষের শেষ আশা-ভরসার জায়গা হচ্ছে উচ্চ আদালত। এই জন্য কোনো আদালত সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা তা গঠনমূলক হওয়া চাই। আজকাল আইন শিক্ষানবিশ আইনজীবী হওয়ার আগে শিক্ষানবিশ আইনজীবী পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন না। পেশাগত জীবনের শুরুতেই মিথ্যা পরিচয়ে বেড়ে উঠছেন। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ব্যবসা পেতে বসেছেন। এসব দেখার কেউ নেই।
মামলার দুটি পক্ষ থাকে। এক বাদী আর বিবাদী। কোনো একপক্ষ আদেশে সংক্ষুব্ধ হতেই পারেন। সেই আদেশ বা রায় নিয়ে জনসম্মুখে আলোচনা-সমালোচনা চলতেই পারে। কিন্তু তাতে পক্ষগণের আইনগত এক বিন্দুও উপকার হবে না। কেনোনা আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। প্রতিটি আইনের সুনিদিষ্ট ফোরাম বা কর্মপদ্ধতি আছে। তাই বাইরে থেকে যতোই চিৎকার করা হোক, তা আদালতের কানে যাবে না, যতোক্ষণ না আইনের পথে হাঁটছে। এই বিষয়টি বিজ্ঞ আইনজীবীদের অজানা নয়। এরপরও আইনজীবীদের মধ্য থেকে আইনের পথ অনুসরণ না করে, আদালত সর্ম্পকে নেতিবাচক মন্তব্য করা, রায় নিয়ে কটাক্ষ করাটা দুঃখজনক। বিচার বিভাগ সম্মান উচ্চাসীন হলে, সমাজে আইনজীবীদের সম্মান বাড়বে।
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইনের দৃষ্টিতে দেশের সকল নাগরিক সমান। সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো নাগরিক আদালতের রায় অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন এবং রাষ্ট্রের সকল কর্তৃপক্ষ নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগীয় ব্যক্তিরা সুপ্রিম কোর্টকে সহযোগিতা করবে। কিন্তু সংবিধানে এসব নির্দেশনার পরও আদালত অবমাননা আইন-২০১৩ তে তা অগ্রাহ্য করা হয়। অথচ সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টকে সহযোগিতা করার কথা বলা হয়েছে। এই সহযোগিতা শুধু আদালতদের বিচারক নন, প্রশাসন, আইনজীবী, সাংবাদিক ও সর্বসাধারন নাগরিকও করতে বাধ্য। বর্তমানে খোদ আইন অঙ্গনে এর ব্যত্যয় ঘটায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
গত ৫ ডিসেম্বর কুমিল্লার সাবেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিচারক সোহেল রানার হাইকোর্টে সাজার বিরুদ্ধে আপিল শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, বিচারক সোহেল রানাকে সকালে হাইকোর্ট এক মাসের সাজা দিলেন। দুপুরে হাইকোর্টের একই বেঞ্চ জামিন দিলেন। বিকেলে চেম্বার আদালত সাজা স্থগিত করলেন। সবই আইনের বিধান মতে হয়েছে। এখানে আইনের ব্যত্যয় হয়নি। এটা আইনজীবীরা সবাই জানেন। অথচ অনেক গণমাধ্যমে হেডলাইন করা হলো ‘বিচারকের সকালে সাজা, দুপুরে জামিন, বিকেলে সাজা স্থগিত’! প্রকৃত সত্য না জেনে কিছু হলেই বিচার বিভাগ ও বিচারকদের নিয়ে গণমাধ্যমে ‘ফ্রি স্টাইলে’ সমালোচনা করা হয়। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো চরিত্র হননের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের কাছে একটা ভুল বার্তা গেলো।
তিনি বলেন, বিচারপতিরা তো নিজেদের ডিফেন্ড করতে পারেন না। সমালোচনার জবাব দিতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে তো আইনজীবীদের, সুপ্রিম কোর্ট বারকে বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষায় ভূমিকা রাখা উচিত। বারের কে সভাপতি, কে সম্পাদক সেটা দেখার বিষয় নয়, সব আইনজীবীকে বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষায় ভূমিকা রাখতে হবে।
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, আদালতকে সম্মানের সঙ্গে না দেখা দুর্ভাগ্যজনক। আদালতের হাত লম্বা হলেও সবকিছু করা যায় না। এ কারণে সিনিয়র আইনজীবীদের ভূমিকা রাখতে হবে। সিনিয়র আইনজীবীদের দায়িত্ব অনেক। বিচার বিভাগ, বিচারকদের মর্যাদা রক্ষায় সিনিয়র আইনজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে একটি মামলায় অভিযোগ গঠন করেন কুমিল্লার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা। আদালত অবমাননার অভিযোগে রুল দেন হাইকোর্ট। আদালত অবমাননার রুলের পর ৩১ আগস্ট বিচারক অভিযোগ গঠনের আদেশ প্রত্যাহার করে নেন। তবে বিচারকের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় হাইকোর্ট তাকে কারাদণ্ড দেন এবং জরিমানা করেন। ওইদিনই হাইকোর্টের একই বেঞ্চে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ (২) ড় ধারায় আপিলের শর্তে জামিনের আবেদন করা হলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। একই দিন অপর এক আবেদনে চেম্বার জজ হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। বিচারককে সাজা দেয়া, সাজা স্থগিতকরা এবং জামিন এর প্রতিটি ধাপই ছিলো আইনসিদ্ধ। কিন্তু গণমাধ্যমে যে আকারে-প্রকারে শিরোনাম করা হয়, তা ছিলো নেতিবাচক।
কেনোনা, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬(২)-এ ধারায় বলা হয়েছে, সাজা যদি এক বছর বা তার চেয়ে কম হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট আদালত অর্থাৎ যে আদালত সাজা দিয়েছেন সেই আদালত আসামির জামিন মঞ্জুর করতে পারেন। এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। একজন বিচারপ্রার্থীর আবেদনে বিচারককে আদালত অবমানার অভিযোগে সাজা দেন হাইকোর্ট। নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের চমক থাকতে পারে, কিন্তু সুসাংবাদিকতার অভাবে সমাজে ভুল বার্তা ছড়াবে। বিচার বিভাগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যার দরুন সমাজের দর্পনেরও উজ্জ্বলতা হারাবে।
অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার কোনো আদেশের বিরুদ্ধে বা মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করা হলে। ডিএলআর-৪৪ এর রেফারেন্সে আইনজীবী সনদ দিয়ে অধস্তন আদালতকে অবহিত করে, তা শুনানি না হওয়া পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম মুলতবি রাখার আবেদন করার সুযোগ ছিলো। কিন্তু অতি সম্প্রতি আইনজীবী সনদ এর ব্যবহার নিয়ে এক আদেশ দেন। যার দরুন ডিএলআর-৪৪ এর রেফারেন্সের কার্যকারিতা নেই। এর ফলে বিচারপ্রার্থীদের জন্য ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। আইনজীবী সনদ ব্যবহার করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। তা না হলে দেখা যাবে কোনো একটি মামলায় উচ্চ শুনানি শেষে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন, কিন্তু উচ্চ আদালতের আদেশ না থাকায় অধস্তন আদালত বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে আইনগত জটিলতার সৃষ্টি হবে। যার সমাধানের পথই বা কী হবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট