সংবিধান, আইন ও সংসদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক প্রয়াত মিজানুর রহমান খান বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক দুর্লভ নথি প্রকাশ করেছিলেন। তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর অন্যতম হলো- ‘‘১৯৭১: আমেরিকার গোপন দলিল’। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার প্রকাশিত অনেক প্রতিবেদন কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে। সেগুলোরই অন্যতম এই প্রতিবেদন। এতে ১৪ ডিসেম্বর নিয়াজির আত্মসমর্পণের প্রস্তাব ঢাকা থেকে দিল্লিতে পৌঁছাতে কেনো ২০ ঘণ্টা সময় লেগেছিলো তার কারণ ব্যাখ্যাসংবলিত মার্কিন নথি ও অপরাপর উৎসের এ বিষয়ক খবরের আনবদ্য বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। সময়ের উপযোগিতা বিবেচনায় অনুসন্ধানী পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি পুন:প্রকাশ করা হলো।
বাংলাদেশের বিজয়ের ক্ষণ কেন প্রায় ২০ ঘণ্টা পিছিয়ে গিয়েছিল, সেটা রহস্যাবৃতই থাকল। একাত্তরে নিয়াজির প্রস্তাব ভারতের কাছে পৌঁছাতে সত্যিই প্রায় ২০ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। এই বিলম্ব না ঘটলে ১৫ ডিসেম্বর হতে পারত বাংলাদেশের বিজয় দিবস। এই বিলম্বের কারণ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। অনেক বিলম্বে হলেও এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ ও নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা জানা গেছে। এর কিছু অংশ চমকপ্রদ বটে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, বিলম্ব ছিল অনিচ্ছাকৃত। ভারতের মতে, এটা পরিকল্পিত। ভারতীয়রা মনে করে, ওই সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের কথা ভেবে সময় নষ্ট করেছিল ওয়াশিংটন।
১৪ ডিসেম্বর নিয়াজির আত্মসমর্পণের প্রস্তাব ঢাকা থেকে দিল্লিতে পৌঁছাতে ২০ ঘণ্টা সময় লাগার কারণের ব্যাখ্যাসংবলিত একটি মার্কিন নথি পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া একাত্তরে প্রস্তুত করা একটি ভারতীয় নথি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, 'বিলম্ব দেখে একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর ভারতের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকেরা সন্দেহ করছিলেন যে, ওয়াশিংটন হয়তো ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ভেবেছিল।'
উল্লেখ্য, অবমুক্ত করা মার্কিন নথি থেকে দেখা যায়, আত্মসমর্পণ প্রশ্নে জেনারেল নিয়াজি ও জেনারেল ফরমান আলীর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল। ঢাকার মার্কিন কনসাল স্পিভাকের কথায়, নিয়াজি রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন ছিলেন। তিনি 'শহীদ' হতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁরা দুজনেই সচেতনভাবে ‘আত্মসমর্পণ' কথাটি এড়িয়ে চলেন। নিয়াজি ও ফরমানের ওই মতানৈক্য সম্পর্কে দিল্লি থেকে ফোনে জেনারেল জ্যাকবের মন্তব্য : ‘আমি মনে করি, নিয়াজি নন, একাত্তরে পাকিস্তানি নৃশংসতার জন্য ঢের বেশি ফরমান আলীই দায়ী।'
সিডনি শেনবার্গ
নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট-এ ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি খবর বেরিয়েছিল যে ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার মার্কিন কনসালের কাছে দেওয়া জেনারেল নিয়াজির যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব ভারতের কাছে পৌঁছাতে যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করে দেরি করেছিল। খবরটি যে ছাপা হবে, তা জানা ছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের। কারণ, ঢাকায় অবস্থানরত সাংবাদিক সিডনি শেনবার্গ ২৫ জানুয়ারি ১৯৭২ এ ভারতে মার্কিন দূতাবাসে ফোন করেছিলেন।
একাত্তরে সিডনি শেনবার্গ জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছেন। কিন্তু ওই ধারণা তিনি অন্তত জ্যাকবের কাছ থেকে পাননি। কারণ, জ্যাকব দিল্লি থেকে ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি শেনবার্গের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছিলাম। ১৪ ডিসেম্বরের অনেক পরে করা তাঁর ওই রিপোর্ট প্রাসঙ্গিক নয়। এ বিষয়ে তিনি কখনো আমাকে কিছু বলেননি। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে তিনি আমাদের সৈন্যদের সঙ্গে ছিলেন।
স্পিভাকের বার্তার বিষয়ে তাঁর কিছু জানার কথা নয়। তা ছাড়া ১৪ ডিসেম্বর সিরাজির যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবই আমরা ১৫ ডিসেম্বর পেয়েছিলাম। সেখানে স্পিভাক বা অন্য কোনো সূত্রে ভারতের কাছে পাকিস্তানি সেনাদের গ্রন্থসমর্পণের কোনো তথ্য ছিল না।' ১৪ ডিসেম্বর নিয়াজির প্রস্তাবসংবলিত তারবার্তায় স্পিভাক তা উল্লেখ করেন।
রাষ্ট্রদূতেরা নিখোঁজ
মার্কিন দলিলে অবশ্য স্পিভাক ও জাতিসংঘের প্রতিনিধি মার্ক হেনরি নিয়াজির প্রস্তাবকে তাঁদের বার্তায় নিজেদের জবানিতে 'আত্মসমর্পণই' উল্লেখ করেছেন। ২৬ জানুয়ারির এই দলিলে একটি ক্ষণপঞ্জি তৈরি করা হয়েছে। সেটি নিচে দেওয়া হলো। এতে ওয়াশিংটন সময় ধরা হয়েছে। এর সঙ্গে ১১ ঘণ্টা যোগ করলে বাংলাদেশ সময় বোঝা যাবে।
সকাল ৮:৪৩, ঢাকা থেকে নিয়াজির প্রস্তাব মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের গ্রহণ। ইসলামাবাদকে “অবিলম্বে” এর সত্যতা নিশ্চিত করতে বলা হয়।
বেলা ১১:৪০, পাকিস্তান প্রস্তাবের সমর্থনে দ্ব্যর্থক উত্তর দেয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র তা পুনরায় যাচাইয়ে উদ্যোগী হয়। জাতিসংঘে বিকেল সাড়ে চারটায় ইসলামাবাদের তরফে যাচাই করা উত্তর পৌঁছায়। ভারতের কাছে তা তুলে দিতে নিউইয়র্কে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের খোঁজ পড়ে। কিন্তু তাঁর সন্ধান মেলেনি। নিউইয়র্কে উপস্থিত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংকে বার্তা দিতে অন্য উপায় ভাবা হয়। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি। নিউইয়র্কে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনের কাছে শেষ পর্যন্ত তা রাত ১১টায় পৌছানো হয়। কিন্তু মধ্যরাতের একটু পরে ভারতীয়রা ফোন করে জানান, তাঁদের যোগাযোগযন্ত্রে কারিগরি ত্রুটি দেখা দিয়েছে। দিল্লিতে তাঁরা বার্তা পাঠাতে পারছেন না। তাঁদের অনুরোধেই দিল্লির মার্কিন মিশনের মাধ্যমে ১৫ ডিসেম্বর বেলা ৩টা ৪০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ১৬ ডিসেম্বরের ভোররাত ২টা ৪০ মিনিটে) ভারতের কাছে প্রথম নিয়াজির বার্তা পৌঁছায়। এরপর ভারত সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে মার্কিন মিশনের উপপ্রধানকে ডেকে এর উত্তর দেয়। ভারতের এই বার্তা নিয়াজির কাছে ঢাকায় সোয়া ১২টায় হস্তান্তর করা হয়।'
মার্কিন দলিলের দাবি, ইচ্ছাকৃত বিলম্বের অভিযোগ তাই ভিত্তিহীন। আর ভারতীয় নথি বলছে, একাত্তরে যা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে প্রকৃত অবস্থা অনেক ভয়ানক ছিল। ভারতের সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা চালাতে তিন ব্যাটালিয়ন মার্কিন মেরিনকে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা ছিল। সে জন্যই তারা বার্তা পৌঁছাতে বিলম্ব করে।
১০ মিনিট আগে: ঢাকা এক গোপন তারবার্তায় ১৬ ডিসেম্বর স্পিভাক ওয়াশিংটনকে জানান, ‘জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরি এইমাত্র আমাকে জানালেন, জেনারেল ফরমানের অনুরোধে তিনি ভারতের দেওয়া আত্মসমর্পণের শর্তে পূর্ব পাকিস্তানি সেনা কমান্ড যে রাজি হয়েছে, সেই বার্তা পাঠিয়েছেন।' হেনরি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে ভারতীয় সেনাদল হেলিকপ্টারে ঢাকায় আসছে। আজ পাকিস্তানি আর্মি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করছে। ভারতের সময়সীমা ছিল জিএমটি ০৩৩০ (বাংলাদেশ সময় সকাল ৯ টা ৩০ মিনিট)। এর ১০ মিনিট আগে জাতিসংঘের রেডিও নেটওয়ার্ক দিয়ে তাদের শর্ত মানার তথ্য জানানো হয়। পাকিস্তানিদের নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়েছিল।'
পশ্চিমে দর-কষাকষি
১৪ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে স্পিভাক বার্তা (৫৬২৮) পাঠান যে গভর্নর মালিক এইমাত্র তাঁকে ফোন করে জানালেন, ইসলামাবাদে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে সমঝোতা চলছে। স্পিভাক এই বার্তায় বলেন, “নিয়াজি ও ফরমান আলীর মধ্যে শক্ত মতভিন্নতা চলছে। এই দুইয়ের মধ্যে মালিক পেন্ডুলামের মতো দুলছেন। ফরমান আলী স্থানীয় পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা বিবেচনায় নিয়ে কিছু একটা বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। কিন্তু নিয়াজি হয় তাঁর উৎসর্গিত সৈনিকের রোমান্টিকতায় বিভোর আছেন, না হয় তিনি ইসলামাবাদের সরকারি অবস্থান অনুসরণ করে ফরমানের বিরোধিতা করছেন। কার্যকর অর্থে এখন এই প্রশ্নটা টগবগিয়ে ফুটছে যে পশ্চিম পাকিস্তানে দর-কষাকষির ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামাবাদ তার সশস্ত্র বাহিনীকে বলি দেবে কি না। এর সঙ্গে অসংখ্য বেসামরিক নাগরিকের ভাগ্য তো জড়িয়ে আছেই।'
বোমার পরে
১৪ ডিসেম্বর এক গোপন তারবার্তায় স্পিভাক লেখেন, আজ ১৭২০ ঘণ্টায় লে. জে. নিয়াজি আমাকে ফোন করেন। বলেন, আমি যেন জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে আমার অফিসে সাক্ষাৎ দিই। তিনি ফরমান আলীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। আমাকে নিয়াজি বলেন, আজ দুপুরে ঢাকা শহরে বোমা হামলার পর তিনি নিশ্চিত যে এই যুদ্ধ এখনই বন্ধ করা উচিত। আরও রক্তপাত এড়ানোর স্বার্থে এটা জরুরি। যদিও তাঁর ভাষায়, তাঁর সৈন্যরা ভালো অবস্থানে আছে এবং এই মুহূর্তে তারা বিপদে নেই। জেনারেল ফরমান তাঁর কাছে রক্ষিত যুদ্ধবিরতির একটি খসড়া বের করেন। বলেন এটা দিল্লি পাঠাতে, যাতে তা ভারতীয়দের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের ভারতীয় ফিল্ড কমান্ডারদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়। কিছুক্ষণ আলোচনা শেষে আমার কাছে লেখা চিঠি হিসেবে তাঁরা তাঁদের প্রস্তাব হস্তান্তর করেন। এটা জেনারেল নিয়াজির সই করা। আর তা সত্যায়িত করেন জেনারেল ফরমান আলী।'
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।