ইউরোপে যুদ্ধ, তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়া, আমদানীকৃত পণ্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বমূল্য, প্রবাসী আয় আশানুরূপ না পাওয়া, অপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর লাগামহীন আমদানিসহ নানা কারণে বৈদেশিক মুদ্রার স্বাস্থ্যবান রিজার্ভ একটু একটু করে তার স্বাস্থ্য হারাতে শুরু করে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের শুরু থেকেই। শনিবার (২২ মার্চ) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়তে আরো জানা যায়, এর আগে যখন রিজার্ভ মাসে মাসে বাড়ছিল তখন সবাই ধরে নিয়েছিলেন এ বৃদ্ধি হয়তোবা চিরদিন অব্যাহত থাকবে। রিজার্ভের নিম্নমুখী ধারা কখনো দেখতে হবে না। নিম্নমুখী এ ধারা যে দেখতে হবে তা বোধ হয় সরকারি-বেসরকারি মহলের পণ্ডিতরা কল্পনায় আনেননি। কল্পনায় আনলে তেল চকচক মাথা দৃশ্যমান থাকা অবস্থায় আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি প্রভৃতি সংস্থার কাছ থেকে অনেক আগেই অর্থ সহযোগিতা চাইত সরকার। তখন চাইলে তুলনামূলক সহজে বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্তি সহজ হতো।
বৈদেশিক মুদ্রার সংকটজনিত সময়ে অনেক প্রশ্ন সবার মাথায় এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। কী করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে? এখন কোন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বৈদেশিক মুদ্রার ড্রেইন কম হবে। কী করলে ড্রেইন হবে না, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে এখন।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিম্নমুখী ধারার মাঝে আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার অর্থ সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছে। একাধিক কিস্তির অর্থ এসেও গেছে। অনেক শর্ত দিয়েছে তারা। সরকার মেনেছে। মর্যাদাপূর্ণ সংস্থার কাছ থেকে কোনো কিছু প্রাপ্তির মাঝে নিজ সম্মান বৃদ্ধির প্রশ্ন জড়িত থাকে। না পেলে মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। তাই আইএমএফের কাছ থেকে শর্তযুক্ত প্রাপ্তির মাঝেও কিছুটা স্বস্তিভাব দেখা গেছে সরকারের আর্থিক মহলে। যে যে পন্থায় বৈদেশিক মুদ্রা অবারিতভাবে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে, অর্থাৎ ড্রেইন হচ্ছে তা রোধ করে কীভাবে রিজার্ভ স্থিতিশীল বা ঊর্ধ্বমুখী রাখতে সাহায্য করা যায় তার আলোচনা চলমান আছে। আইএমএফ হয়তো বৈদেশিক মুদ্রার ড্রেইন হওয়া রোধ করতে পরামর্শ দিয়েছে। তবে বিদেশে শিক্ষা গ্রহণের নামে যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ড্রেইন বা অপচয় হচ্ছে এবং অবৈধভাবে মুদ্রা পাচার হচ্ছে তা রোধ করতে সরকারি মহল আইএমএফের কাছে কোনো পরামর্শ চেয়েছে কিনা বা নিজ থেকে তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে কিনা তার কোনো সংবাদ অবশ্য জানা যায়নি। শিক্ষা গ্রহণের নামে আমরা বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণের যে পথ সবার জন্য উন্মুক্ত রেখেছি, সেক্ষেত্রে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হচ্ছে তা কি ভেবে দেখেছি আমরা? মনে হয় ভেবে দেখিনি।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রাপ্রাপ্তির উৎস হাতে গোনা যায়। নির্দিষ্ট কয়েকটি খাত হতে প্রাপ্ত রফতানি আয়, প্রবাসী নাগরিকের আয়। সেই সঙ্গে আছে বৈদেশিক প্রকল্প সাহায্য, অনুদান, বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রভৃতি। তবে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হওয়ার নানা খাত আছে। পণ্য ও সেবা আমদানি, বিলাসী, অ-বিলাসী, অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি, অপ্রয়োজনীয় সরকারি-বেসরকারি বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশে অপ্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও বিদেশে শিক্ষালাভ, অন্য দেশ থেকে নেয়া আগের ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ।
বৈদেশিক মুদ্রা খরচের খাত অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাওয়া ও খরচ অস্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয়। ঘাটতি ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকায় রিজার্ভ কমতে শুরু করে। আলোচিত এ রিজার্ভ কিছুদিন আগেও ৫০ বিলিয়ন ডলার ছুঁইছুঁই ছিল। তবে তা এখন ২০ মার্চ ২০২৪ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। এ অবস্থায় একটি ডলারেরও ড্রেইন হওয়া চিন্তার বিষয় এবং তা রোধ করার পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
রিজার্ভ যদি স্বস্তিকর অবস্থায় থাকত তবে হয়তো বৈদেশিক মুদ্রার বহুমুখী ড্রেইন নিয়ে কেউ ভাবতেন না। আলোচনা হতো না খরচের খাত নিয়ে। অভাব যখন জানালায় উঁকি দিয়ে ভয় দেখায়, তখন বন্ধ দরজা আরো বেশিসংখ্যক তালা দিয়ে বন্ধ করে অভাবকে কোনোভাবেই ঘরে না ঢুকতে দেয়া শ্রেয়। বৈদেশিক মুদ্রার অভাব রোগটি যখন জানালায় উঁকি দিল, তখন আমরা ধরে নিলাম আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি খাতে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিলাসী ভ্রমণ বাড়ছে, বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে অর্থের অপচয় বাড়ছে। কিন্তু যে বিষয়টি সবার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে, তা হলো বিদেশে শিক্ষালাভের নামে অর্থ প্রেরণের বিষয়টি। এ অর্থ প্রেরণ হচ্ছে বৈধ ও অবৈধ পথে। সরকারি মহলে হয়তোবা বৈধ পথে প্রেরিত অর্থের তথ্য থাকবে বা আছে, কিন্তু অবৈধ পথে বের হয়ে যাওয়া অর্থের পরিমাণের হিসাব নেই। থাকার কথাও নয়।
দেশে যে বিষয়ে শিক্ষালাভের সুযোগ নেই, সে বিষয়ে শিক্ষালাভের জন্য ছাত্রছাত্রীরা বাইরে যাবে। ছাত্রছাত্রীরা উন্নত শিক্ষা লাভ করতে বা শিক্ষকরা উন্নততর শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে যাবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত বা প্রশ্নবিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে তখন; যখন অপ্রয়োজনে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যাওয়া হচ্ছে। প্রথমে শিক্ষালাভের নামে সন্তানকে পাঠানো, এরপর সন্তানের পিআর বা নাগরিত্ব হয়ে গেলে সম্পদ বিক্রি করে অবৈধভাবে অর্থ প্রেরণ করে বিদেশে বাড়ি ক্রয় এবং চিরস্থায়ী হওয়া। এই কালচার এখন বেশ জনপ্রিয়।
অনেকের কাছে; সন্তান বিদেশে পড়ছে—এ বিষয় অন্যকে বলা এখন ‘ফ্যাশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কষ্টে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অনায়াসে প্রেরণ করার অনুমতি দিয়ে এ ধরনের ফ্যাশনের প্রদর্শনী অব্যাহত রেখেছি আমরা। ব্যাংকে একটি স্টুডেন্ট ফাইল খুলে চাইলে বিদেশের শিক্ষায়তনের সব ফি, থাকা খরচ এবং ব্যক্তিগত খরচ পানির মতো পাঠানো যায়। একটি ৩০ হাজার ডলারের এলসি খুলতে যখন ব্যাংকের দরজায় ঘুরতে হচ্ছে ৩০ দিন বা তার চেয়েও বেশি সময়, সেখানে ৩ ঘণ্টা বা তার চেয়েও কম সময়ে শিক্ষার ব্যয় মেটানোর নামে অর্থ প্রেরণ করা যাচ্ছে। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে বলে কথা! কিন্তু যে শিক্ষার্থীর জন্য অর্থ প্রেরণ করা হচ্ছে সে কি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসবে? তার মেধা দেশের কাজে না এলে তার জন্য দেশ কেন বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করবে? অন্যরা অর্থাৎ যারা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন তাদের না হয় অধিকার আছে সে মুদ্রা খরচ করার, কিন্তু যারা কস্মিনকালে একটি ডলারও দেশে আনেনি তারা কেন অবাধে বৈদেশিক মুদ্রা খরচের অনুমতি পাবে সন্তানের শিক্ষার নামে?
চাইলেই একজন মুরগি ব্যবসায়ী, একজন ছিনতাইকারী, একজন ডাকাতও তার সন্তানকে বিদেশে শিক্ষালাভের জন্য পাঠাতে পারেন। ভিসা জোগাড় করতে পারলে হলো। ব্যাংকের দেখার প্রয়োজন নেই একজন ব্যক্তি তার সন্তানের জন্য যে অর্থ পাঠাতে এসেছেন; বিগত অর্থবছর শেষে তার ট্যাক্স ফাইলে সে পরিমাণ অর্থ জমা ছিল কিনা? বা তার আয় বৈধ কিনা?
মাঝেমধ্যে আলোচনা হয় ব্রেইন ড্রেইন হয়ে যাচ্ছে। মেধাবী ছাত্ররা বিদেশে পড়তে যাচ্ছে; কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো বেশির ভাগ ছাত্র আর ফেরত আসছে না। যে দেশে যাচ্ছে, তারা সেখানে পড়া শেষে পিআর নিয়ে স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে। দেশে বৈধ ও অবৈধ পথে প্রচুর অর্থকড়ির মালিক হয়েছেন তাদের অমেধাবী সন্তানরাও বিদেশে পড়তে যাচ্ছে। তারা তাদের পিতা-মাতার সেখানে প্রেরিত বা প্রেরিতব্য অর্থের দেখভাল করবে বিবেচনায় সেখানে পাঠানো হচ্ছে। এমন ছাত্রদের পড়তে যাওয়া এবং পরে না ফিরে থেকে যাওয়া ব্রেইন ড্রেইন না হলেও বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার ড্রেইন যে হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন ব্রেইন ড্রেইন এবং ডলার ড্রেইন রোধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি? সহজ উত্তর না। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে এ অনিয়ম রোধ করতে হবে এই মুহূর্তে করণীয়:
প্রথমত, এ মুহূর্তে যেসব শিক্ষার্থী বিদেশে পড়ছে তার একটি তালিকা তৈরি করা দরকার। সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে তথ্য জানানোর জন্য আহ্বান জানালে সব পিতা-মাতা বা অভিভাবক সে তথ্য প্রদান করবেন। সহজ কথায় বলা যায়, তথ্য প্রদান করতে বাধ্য হবেন।
দ্বিতীয়ত, এ পর্যন্ত পড়তে কত টাকা বৈধ পন্থায় পাঠানো হয়েছে, তা সরকারকে জানাতে হবে সে ফরমের মাধ্যমে।
তৃতীয়ত, গত ১৫ বছরে যে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা শেষ করেও দেশে ফিরে আসেননি তাদের পিতা-মাতা ওই নির্দিষ্ট ফরমে কারণ জানাবেন; কেন তারা দেশে আসেননি। বিদেশে থাকাকালীন তাদের জন্য কত অর্থ প্রেরণ করা হয়েছে এবং শিক্ষা শেষে সন্তানরা কত অর্থ পিতা-মাতাকে প্রেরণ করেছেন? এমন নয় যে, সরকার পিতা-মাতার কাছে প্রেরিত অর্থের ভাগ চাইবে। তবে প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে অবশ্যই বৈদেশিক মুদ্রার আগমন দরকার।
চতুর্থত, যারা অতীতে তাদের সন্তানদের বিদেশে প্রেরণ করেছেন এবং বর্তমানে যারা পাঠাতে মনঃস্থির করেছেন তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সরকারকে অঙ্গীকারনামা প্রদান করবেন যে, শিক্ষার জন্য যে অর্থ প্রেরিত হয়েছে বা যে অর্থ প্রেরণ করা হবে; শিক্ষা শেষে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে অর্থ তার সন্তানরা পিতা-মাতার ব্যাংক হিসেবে প্রেরণ করবেন, যদি সে সন্তান দেশে ফেরত না আসে। বৈদেশিক মুদ্রাপ্রাপ্তি না হলে পিতা-মাতা সরকারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করবেন। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ সরকার অভিজ্ঞ মহলের সঙ্গে বসে ঠিক করবে।
পঞ্চমত, সরকার সংশ্লিষ্ট দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করতে পারেন ছাত্রছাত্রীদের তখনই যেন চূড়ান্ত নাগরিত্ব দেয়া হয়, যখন বৈধভাবে ওই ছাত্রছাত্রী তার নিজ দেশে তার পিতা-মাতাকে সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ সম্পন্ন করেছেন।
সরকারের নিশ্চয় জানা আছে, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে মোট ৫২ হাজার ৭৯৯ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য বিদেশে গেছে। তবে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই বাংলাদেশ থেকে ৮ হাজার ৫২৪ জন ছাত্রছাত্রী উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য গেছেন। ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য বলছে—ওই বছর যুক্তরাজ্যে ৬ হাজার ৫৮৬, কানাডায় ৫ হাজার ৮৩৫, মালয়েশিয়ায় ৫ হাজার ৭১৪ ও জার্মানিতে ৫ হাজার ৪৬ জন গেছেন। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় গেছেন ৪ হাজার ৯৮৭, জাপানে ২ হাজার ৮২, ভারতে ২ হাজার ৬০৬, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ হাজার ২০২ জন এবং অন্যান্য দেশে গেছেন সব মিলিয়ে ১ হাজার ২১৭ জন শিক্ষার্থী। উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর নাগাদ শিক্ষার ব্যয় নির্বাহে শুধু বৈধ চ্যানেলে ১৩৯ দশমিক ৬৪ কোটি ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরিত হয়েছে।
চোখ বন্ধ করে বলা যায়, সবটুকু না হলেও অধিক সংখ্যক মেধা পাচার হচ্ছে। তাই বলা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার ড্রেইন হচ্ছে। ব্রেইন ড্রেইন এবং বৈদেশিক মুদ্রার ড্রেইন এখনই বন্ধের উদ্যোগ না নিলে আর কবে সে উদ্যোগ নেয়া হবে? তবে প্রশ্ন, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? তার কি সে সাহস আছে?
লেখক : মোহাম্মদ মারুফ হোসেন, সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেজিইএ)