বিজয়ের একান্নতম বার্ষিকী উদযাপনের ঠিক দুই দিন আগে পৃথিবী থেকে চির-বিদায় নিলেন একাত্তরের বীরযোদ্ধা ড. আলাউদ্দিন আহমেদ। তিনি একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে যতটা আমাদের কাছে পরিচিত, তার চেয়ে বড়ো পরিচয় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন একজন লড়াকু নৌ-কমান্ডো। প্রিয়প্রাণ বাজি রেখে এই নৌ-কমান্ডো লড়াই করেছেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে, মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে।
একাত্তরের এই বীরযোদ্ধা গত ১৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিকালে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন।
তিনি ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানার বুরুদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ও ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জাপানের তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
সাবেক সংসদ সদস্য ড. আলাউদ্দিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ১৮ জুলাই থেকে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ড. আলাউদ্দিন আহমেদের রয়েছে অসামান্য অবদান। ড. আলাউদ্দিন ও তাঁর দল একাত্তরে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের মেঘনা নদীতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করেন। বিজয় অর্জন পর্যন্ত তাঁরা মেঘনা তীরবর্তী এলাকায় অবস্থান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ত্বরান্বিত করেছিল বাংলার এসব নদ-নদী। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ইতিহাসের পাতায় চোখ ফেরালেই দেখা যায়, সে সময় অসংখ্য যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল খোদ নদীতেই। নদীতে সংঘটিত ছোট-বড় এসব যুদ্ধে বীর বাঙালির কাছে পরাস্ত হয়েছে পাকি-হানাদার বাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে অর্থাৎ এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে কিশোরগঞ্জেভৈরবের মেঘনা নদীতে পাক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের বিষয়ে মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম বলেন, ‘মেঘনা নদীতে সংঘটিত লড়াই হচ্ছে মুক্তি সংগ্রামের প্রথম প্রস্তুতিমূলক লড়াই। এর মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনীর অস্ত্র ক্ষমতার সঠিক পরিমাপ করা সম্ভবপর হয়। শত্রুপক্ষ আকাশ এবং নৌপথে কতটা স্বাচ্ছন্দ বিচরণে সক্ষম তাও বোঝা যায়।’
পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব অংশে প্রবাহিত মেঘনা নদী যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। পাকিস্তানি, মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারাও কৌশলগত কারণে চাঁদপুর ও আশুগঞ্জে মেঘনা নদীর সম্মুখবর্তী এলাকা সম্পূর্ণরূপে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে। কারণ, এই এলাকা দখলে নিতে পারলে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। আর তখন ঢাকা দখলের অভিযান আরও সহজ হয়ে যাবে। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা চাইছিলেন মেঘনা নদীর ওপরে স্থাপিত ভৈরব রেল ব্রিজটি ভেঙে দিতে, যাতে পাকিস্তানিদের অবাধ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। এর অংশ হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল ইসলাম এবং তাঁর দল একটি অপারেশন চালায়। যার বর্ণনা রয়েছে অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু'র ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং আশুগঞ্জ’ বইতে। রেলব্রিজ অ্যাটাকের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতিই আমার চোখে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে আশুগঞ্জ ভৈরব রেলব্রিজ অ্যাটাকের ঘটনাটি বেশি মনে পড়ে। আমরা যখন ভারত থেকে ট্রেনিং শেষ করে দেশে ফিরে আসি-তখন নৌ-কমান্ডোর একটি গ্রুপকে আমার সাথে পাঠানো হয় আশুগঞ্জ-ভৈরব রেলব্রিজটি ধ্বংস করার জন্য। প্রফেসর আলাউদ্দিন (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও জাতীয় সংসদ সদস্য)সহ দু-জন নৌ-কমান্ডো বর্তমান আশুগঞ্জ জিয়া সার কারখানা এলাকা থেকে নদীর উজান বেয়ে সাঁতরিয়ে ব্রিজের পিলারে এক্সপ্লোসিভ স্থাপন করে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা আশুগঞ্জ সাইলোর দক্ষিণ পশ্চিমদিকে নদীর তীরে তাদের জন্য অপেক্ষা করার কথা। মূলত নৌকমান্ডোদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যই আমরা সেখানে অবস্থান নিই। সাইলোতে তখন পাকিস্তানি সৈনাদের ক্যাম্প ছিল। আমরা নির্ধারিত সময়ের পরও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করি। এদিকে ব্রিজের দিক থেকে কোনো বিস্ফোরণের আওয়াজও শুনছি না। অপরদিকে কমান্ডোদেরও কোনোখবর পাচ্ছি না। এরই মাঝে রাত শেষে সকাল হয়ে যাচ্ছে। এখানে আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। এমনই একটি অবস্থার মধ্যে পূর্বদিকে সূর্য উদিত হওয়ার পর আমরা নদীর তীর দিয়ে দক্ষিণ দিকে এগোতে থাকি। সামনে গিয়ে চরচারতলার নদীর তীরে নৌকমান্ডো এনামুল হক মানিককে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। তিনি ড্রেজারের পানির ঘূর্ণিতে আটকা পড়ে আর সামনে এগোতে পারেননি। ফলে কোনোরকম নদীর তীরে এসে অজ্ঞান হয়েপড়ে থাকেন। পরে শুনেছি, প্রফেসর আলাউদ্দিন একা ঠিকই ব্রিজের পিলারে যথাসময়ে এক্সপ্লোসিভ রেখে কর্টে পেঁচিয়ে ডিলে সুইচ অন করে ফিরে আসেন। এক্সপ্লোসিভের বিস্ফোরণ ঘটলে পিলারের নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পিলারটির ওপরাংশ ধ্বংস হয়নি। ব্রিজ থেকে ফিরে আসার পথে আলাউদ্দিন নদীতে মাছের জালে আটকা পড়লে এই সময় তার সাথে রক্ষিত ড্যাগারের সাহায্যে জাল কেটে তিনি বের হয়ে আসেন। ফিরে আসার পথে পুনরায় তার পায়ের আঙুলে মাছ ধরার বড়শি বিঁধে গেলে বহু কষ্টে তিনি বড়শি থেকে নিজেকে মুক্ত করে নদীতে জেলেদের একটি নৌকায় করে পরবর্তীতে আমাদের সাথে মিলিত হন। আলাউদ্দিন প্রফেসরকে না পেয়ে আমরা তখন মনে করেছি-তিনি হানাদারদের হাতে ধরা পড়েছেন।’
ভয়ংকর এই যুদ্ধের বর্ণনার মধ্য দিয়ে আমরা অন্য এক লড়াকু বীরযোদ্ধা আলাউদ্দিন আহমেদকে জানতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে বাংলাদেশ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। বিনম্র শ্রদ্ধা নৌযোদ্ধা ড. আলাউদ্দিন আহমেদ।
লেখক : ফয়সাল আহমেদ, সম্পাদক- বই বিষয়ক ত্রৈমাসিক ‘এবং বই’