স্কটল্যান্ড কড়চা-২বিনোদন আর মুগ্ধতার মেলবন্ধন

নাইমুল আজম খান |

আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন ঘটেছে। স্বাস্থ্যসচেতনতাও বেড়েছে উল্লেখ করার মত। আগে ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনে ডিগ্রির তালিকায় বিএইচএস (আপার) লেখা থাকত। আদতে এটা কোনও ডিগ্রি নয়। কিন্তু এমন একটা তথ্য জুড়ে দিয়ে কতিপয় ডাক্তার বেমালুম ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে এ ফাঁকিটা ইদানিং অনেকে বুঝে গেছে। তাই চিকিৎসা নিতে এখন সবাই দেখে ডাক্তারের এমডি/এফসিপিএস বা এফআরসিএস ডিগ্রি আছে কিনা? এসব ডিগ্রি আবার কোথায় থেকে নেয়া, সেটা নিয়েও প্রশ্ন থাকে কারো কারো। আমার এক ভাই যিনি ডাক্তার,  প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। বর্তমানে বারডেম হাসপাতালের ন্যায়পাল। তার প্রেসক্রিপশনে ছোটবেলায় আবিষ্কার করেছিলাম এফআরসিএস (গ্লাসগো) লেখাটি। পরে বুঝেছিলাম চিকিৎসাশাস্ত্রের বড় ডিগ্রি অর্জনের তীর্থস্থান স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো এবং এডিনবরা। সে স্কটল্যান্ডের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় আজ আমরা।

আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিম উপকূলে গ্লাইড নদীর তীরে গ্লাসগো ছিল এক সময় ইউরোপের নেতৃস্থানীয় শিল্পশহর। এটাকে চার্চের শহর, ক্যাথেড্রালের শহরও বলা হয়। সারা বছর সাংস্কৃতিক চর্চা হয় বলে একে ইউরোপের সাংস্কৃতিক শহর বলেও বিবেচনা করা হয়। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ-এ বিশ্বের সব চেয়ে সুন্দর দেশ হিসেবে স্কটল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

স্কটল্যান্ডের সৌন্দর্য আরোপিত নয়। প্রাকৃতিকভাবেই এই দেশটি সৌন্দর্যমণ্ডিত। অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ, আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে রঙ বদলানোর মতো নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর মনুষ্যসৃষ্ট সুরম্য কাঠামোয় স্কটল্যান্ড পরিণত হয়েছে ইউরোপের সুন্দরতম দেশে। প্রতি বছর তাই লাখ লাখ সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটকের ভীড় জমে এ দেশে। স্কটিশ হাইল্যান্ডকে বলা হয় ‘রোমান্টিক প্লেস অভ এরা’। দুনিয়ার সব প্রেমিক যুগলের মধুচন্দ্রিমার ঠিকানা তাই এই হাইল্যান্ড। যুক্তরাজ্যের সব চেয়ে উঁচু পাহাড় বেননেভিসের অবস্থান স্কটল্যান্ডে। উচ্চতা ৪ হাজার ৪১৩ ফুট বা ১ হাজার ৩৪৫ মিটার।

বেননেভিসে দেখা হলো এক দম্পতির সঙ্গে। সুজানা আর ক্রিস্টোফার। সুজানা পেশায় শিক্ষক, ক্রিস্টোফার শিল্পী। সুজানার এটি দ্বিতীয় বিয়ে। ছাত্রাবস্থায় প্রেম হয়েছিল দুজনের। কিন্তু বিয়ে হয়নি। সুজানা তার ৬২ আর ক্রিস্টোফার ৫৫ বসন্তে এসে এক হয়েছে। ওদের দেশে বিয়েটা কোনও ব্যাপার নয়, এক সঙ্গে থাকাটাই হলো বিষয়। তবুও ওরা বিয়ে করেছে। পাত্রের তুলনায় পাত্রী বয়সে বড়, চলৎশক্তিহীনও কিছুটা। কিন্তু তাতে কী? দুজনের চোখে মুখে সে প্রথম প্রেমের দীপ্তি। ভাল লাগল এই ভেবে, ওরা প্রমাণ করেছেন প্রেম শাশ্বত; এর কোনও বয়স নেই।    

বিনোদন আর মোহময়তার মেলবন্ধন আছে স্কটল্যান্ড জুড়ে। অনেক দর্শনীয় স্থান আছে সে তালিকায়। এডিনবরা ক্যাসেল দুর্গ, রিভারসাইট মিউজিয়াম, লকনেস লেক, উডহার্ট ক্যাসেল, স্কটিশ হাইল্যান্ড এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আবেরদিনকে বলা হয় ইউরোপের ট্রেজার আইল্যান্ড। দ্বীপবেষ্টিত স্কটল্যান্ডের উপকূল ইংল্যান্ড তো বটেই, পুরো ইউরোপের মধ্যে অগ্রনী। এদের উপকূলের দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ৯১০ কিলোমিটার। ব্যবস্থাপনার বিশেষত্বের অভাবে বিশ্বের সব চেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত হওয়া সত্ত্বেও কক্সবাজারে আমরা পর্যটক আকর্ষণ করতে পারি না। অথচ ওদের সমুদ্র সৈকত দেখতে বছরে নাকি দশলাখ লোকের সমাগম ঘটে। দ্বীপবেষ্টিত স্কটল্যান্ডে গিয়ে মজার এক তথ্য পেলাম। পৃথিবীর সব চেয়ে ছোট বাণিজ্যিক ফ্লাইট নাকি পরিচালিত হয় ওখান থেকে। মাত্র ১ দশমিক ৪৭ মাইল দূরত্বের দুটি দ্বীপকে সংযুক্ত করতে কয়েক মিনিটের এই ফ্লাইট পরিচালিত হয়। 

শুরুতে যে কথা বলেছিলাম। শিক্ষাক্ষেত্রে স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যভুক্ত অন্য দুই রাজ্য ওয়েলস ও নর্থ আয়ারল্যান্ড থেকে এগিয়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে গ্লাসগোর। এ কারণে চিকিৎসা শাস্ত্রের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে দুনিয়াসুদ্ধ ডাক্তাররা ভীড় জমান ওখানে। পৃথিবীর প্রথম হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছিল ওই স্কটল্যান্ডেই। স্কটল্যান্ডে বিভিন্ন বিষয়ে আছে নানা জাদুঘর। সেরকম একটি জাদুঘর ফিজিওলজি দেখলাম গ্লাসগো শহরে। নার্সিংসহ চিকিৎসা বিষয়ে আরো কিছু জাদুঘর আছে এখানে, যা চিকিৎসাশাস্ত্রে স্কটিশদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। এবারের স্কটল্যান্ড সফরে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে গেলাম।শুরুতে যে বলেছিলাম শৈশবে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে গ্লাসগো আবিষ্কারের কথা, সেটাই হয়তো তাড়িত করেছে ওখানে যেতে। ৫৭০ বছর আগে ১৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয় এটি। বর্তমান ছাত্রসংখ্যা ৩০ হাজার ৮৫০। পাপালবুল প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে। চিকিৎসার মধ্যে মেডিসিন, নার্সিং, দন্ত চিকিৎসা, ভেটেরিনারি ও প্রকৌশল বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা দেয়া হয় এখানে। শুরুর দিকে না হলেও বর্তমানে আইন, কলা, সমাজ বিজ্ঞান বিষয়েও শিক্ষাদান করা হয়। ইংরেজিভাষী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এটির অবস্থান সারা বিশ্বে চতুর্থ। ১৮ শতকে ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই প্রথমে অভিজাতদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠলেও বর্তমানে মধ্যবিত্তরাও এখানে পড়াশোনা করে। তবে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ব্যয়বহুল। আমাদের ড্রাইভার স্কট জানালেন, ওর তিনরুমের ফ্ল্যাটবাড়ির ভাড়ার সমান টাকা গুনতে হয় এখানকার এক রুমের ফ্ল্যাটে। এ যাবৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন শিক্ষার্থী গবেষণায় লাভ করেছেন নোবেল পুরস্কার। তিনজন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী, এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জেমস উইলসনও নাকি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। 

ধর্ম নিয়ে নানাবিধ আলোচনা আছে আমাদের সমাজে। পশ্চিমা বিশ্ব একজন লাদেনকে খুঁজে বের করতে আকাশ-পাতাল এক করে ফেলে, তখন খোদ ইউরোপেই চলে সাম্প্রদায়িক শিক্ষা। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে পড়ানো হয় ‘দেবত্ব’ নামে ধর্মীয় পাঠ্যক্রমও। আমরা যখন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, সেখানে দেখা হলো এক পাকিস্তানি শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ছবি তোলার প্রয়োজনে তার সহযোগিতা চাইলাম। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে বেশ পুলকিত হলো বলে মনে হলো। জিজ্ঞেস করলাম, বাংলাদেশ কি ভাল লাগে? উত্তরে বলল, কেবল বাংলাদেশ নয়, ভাল লাগে বাংলাদেশের মানুষকেও। মনে মনে ভাবলাম, বিড়াল বিপদে পড়লে গাছে ওঠে। তাই ‘মাছলিখোর’ বলে এক সময় যাদের টিপ্পনী কাটতে, এখন তারাই তোমাদের পছন্দের তালিকায়। বিষয়টি মজারই বটে। 

স্কটল্যান্ডে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, মানের দিক থেকে যা অক্সফোর্ড, কেমব্রিজের কাছাকাছি। ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যরাও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। প্রিন্স উইলিয়াম ক্যাথেড্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। স্কটল্যান্ড ছাড়ার আগে গ্লাসগো শহরের ইউনিভার্সিটি অভ দ্য ওয়েস্ট স্কটল্যান্ড দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। বলে রাখা ভাল, পৃথিবীতে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার সূচনাও হয়েছিল স্কটল্যান্ডেই। ক্লিনিক এবং হাসপাতালের সুতিকাগারও এদেশ। শিক্ষা ও সভ্যতার পাদপীঠ বলেই হয়তো এমন হয়েছে।

শেষ করছি প্রবাসী এক স্বজনের কথা দিয়ে। গ্লাসগোতে বসবাস করেন আমার এক ভাই ডা. দুলাল। শল্যচর্চার যশস্বী চিকিৎসক তিনি। ছোটবেলায় যখনই ওনাদের বাসায় বেড়াতে যেতাম, তখনই ওনাকে পড়ার টেবিলে দেখতে পেতাম। ডাক্তারদের হয়তো একটু বেশিই পড়াশোনা করতে হয়। চাকরি আর উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ চলে যাওয়ায় দীর্ঘসময় যোগাযোগ ছিল না তার সঙ্গে। ভাই বিয়ে করেছেন ইরানী মেয়ে। সন্তানরা এখন পুরো দস্তুর স্কটিশ। কিন্তু উনি আছেন আগের মতোই। পুরোপুরি বাঙালি । ভাত ছাড়া তার চলে না। নিজেই রান্না করে খান দেশীয় সব খাবার। গ্লাসগোতে এসেছি শুনে করোনা সময়ে হাসপাতালে ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও তিনি  এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। খাওয়া দাওয়া আর স্মৃতিচারণ করে কাটল কিছুটা সময়। বললাম, ওনার মত মেধাবী চিকিৎসক দেশের জন্য খুব দরকার। উনি একমত হলেন, তবুও জানালেন প্রবাসী জীবনটাকে ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন। আসার সময় বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।
গাড়িতে উঠে বসতে কোথায় যেন একটা কষ্ট অনুভব করলাম। মনে হলো, নিতান্তই কাছের কিছু একটা ফেলে যাচ্ছি। ওনারও হয়তো খারাপ লাগছিল। বুঝতে পারছিলাম, চারপাশে এত ঐশ্বর্য, কিন্তু কোথায় তিনি যেন নিতান্তই একা। প্রবাসীদের জীবনটা হয়তো এমনই। তবুও সব কিছুর পর প্রত্যাশা, ভালো থাকুক আমাদের প্রবাসী স্বজনরা।

লেখক : নাইমুল আজম খান, উপসচিব, জাতীয় সংসদে কর্মরত।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0057501792907715