বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতীক

ফয়সাল আহমেদ |

আজ মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর জন্মদিন। ১৩৪ বছর আগে বাংলার নির্যাতিত-নিপীড়িত, মুক্তিকামী মানুষের প্রিয় মহারাজের জন্ম ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ মে, ২২ বৈশাখ ১২৯৬ বঙ্গাব্দে তদানীন্তন ময়মনসিংহ জেলা, বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার অন্তর্গত কাপাসাটিয়া গ্রামে। ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া এক বিপ্লবীর নাম ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী।  লোকে যাঁকে মহারাজ বলে ডাকে। তিনি বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতীক। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কারণে অগ্নিযুগে যে কয়জন ভারতবর্ষে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, ব্রিটিশ শাসকদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তাঁদের অন্যতম।

বিপ্লবী শ্রী মতিলাল রায়, ‘আমার দেখা বিপ্লব ও বিপ্লবী’ বইয়ে দেখিয়েছেনÑ ‘ত্রৈলোক্যনাথকে কেহ-কেহ ‘ঠাকুর’ বলিয়া ডাকিত। ত্রৈলোক্যনাথ ছিল একজন পলাতক আসামী। সে প্রতিদিন গঙ্গাস্নান করিত এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ন্যায় চলাফেরা করিত। ‘মহারাজ’ নামে তাহার খ্যাতি আজিও বাংলার বিপ্লবীদের নিকট বিদিত। পলাতক আসামী হইয়াও, সে ছদ্মবেশে আদালত-প্রাঙ্গণে ডাব বেচিবার ছলে উপস্থিত হইত এবং বিচারের ফলাফল অবগত হইত। নৌকার মাঝিরূপে সে পুলিসের দৃষ্টি এড়াইত। ত্রৈলোক্যনাথের সহিত পরিচয় করিয়া আমি আরও কয়েকজন খাঁটী বিপ্লবীর সন্ধান পাইলাম।’

মহারাজ ডাকাতি করেছেন, খুন করেছেন, টাকা জাল করেছেন। তবু মানুষ তাঁকে ভালোবাসত। কারণ, তিনি এসবের কিছুই নিজের জন্য করেননি। সবই করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। ডাকাতি কিংবা খুন করা তাঁর পেশা ছিল না। তবে এ নিয়ে মহারাজের আক্ষেপ ছিল। তিনি বলতেন, ‘স্বাধীন ভারতে আমাদের হাতে যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকত, তবে আমরা যাদের বাড়িতে ডাকাতি করেছি, তাদের বংশধরদের মধ্যে যারা বিপন্ন, তাদের সরকারিভাবে সাহায্য করতাম।’

বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে পলাতক অবস্থায় মহারাজকে ছদ্মবেশে নানাস্থানে থাকতে হয়েছে। এই সময়ে কখনও পয়সাওয়ালা ধনী মানুষ, কখনও মাঝি, কখনও চাকর বা কুলির রুপ ধারণ করতে হয়েছে। যখন নৌকায় থাকতেন তখন মাঝির বেশে থাকতেন। নৌকা নিয়ে পূর্ববঙ্গে অনেক ডাকাতি করেছেন। ডাকাতির সময় বড় ঘাসী-নৌকা ব্যবহার করতেন।  নিজেরাই এই নৌকা চালাতেন। তখন স্বদেশী ডাকাত ধরার জন্য পুলিশ খুব তৎপর ছিল। পুলিশ বিভিন্ন ঘাটে নৌকা থামিয়ে তল্লাশি চালাতো। যেভাবেই হোক স্বদেশী ডাকাতদের ধরা তাদের জন্য ফরজ হয়ে উঠেছিল। নদী-নৌকা-লঞ্চ সর্বত্র ঘোরাফেরা করতো পুলিশের দল। নদী আর নৌকায় থাকতে থাকতে এক সময় মহারাজ ‘কালীচরণ মাঝি’ নামে খ্যাতিমান ওয়ে উঠলেন। বহুদিন নৌকায় নৌকায় কাটিয়েছেন, দীর্ঘদিন  নৌকা যাপনে তাঁর চেহারাও মাঝির মতো হয়ে গিয়েছিল। কেমন ছিল ডাকাত ত্রৈলোক্যনাথের রূপ? 

জিতেশচন্দ্র লাহিড়ী তাঁর ‘নমামি’ গ্রন্থে লিখেছেন-‘পদ্মা ও মেঘনা নদীর গ্রামগুলির ধনী মহাজনদের বাড়ীতে পরপর কয়েকটা ডাকাতি হয়েছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ডাকাত দলের নেতা এক কৃষ্ণকায় পাঞ্জাবী। প্রকাণ্ড বড় তার দাড়ি। নদীতীরের বড় লোকদের মনে সে একটা রীতিমত বিভীষিকা। কত অদ্ভুত কাহিনী গড়ে উঠেছে তার সম্বন্ধে। কেউ বলে পুরাণের শব্দভেদী বাণ আয়ত্ব করেছে সে। শব্দ লক্ষ্য করেই সে ছোড়ে অব্যর্থ গুলি। কেউ বলে লাঠি ভর করে এক লাফে ওঠে দোতলায়। অবলীলাক্রমে লাফ দিয়ে পড়ে ভূমিতে। হাত দিয়ে ভাঙে সিন্দুকের তালা, হুঙ্কার দেয় দৈত্যের মত। নির্ম্মম পাষাণ সে। অথচ কোন ক্ষেত্রেই করেনি সে নারীর অসম্মান। এক বাড়ীতে একজন দস্যু এক মহিলার অঙ্গ থেকে গয়না খুলে নিচ্ছিল। কিন্তু সহসা কে যেন তার দুকান ধরে তুলে ধরল শুন্যে। সকলে চেয়ে দেখল সেই দুর্ধর্ষ পাঞ্জাবী। এও শোনা যায় ডাকাতি করতে যেয়েও সে রোগীর সেবা করে, বাড়ীর মেয়েদের কাছে জল চেয়ে খায় আর বলে কুচ্চু ভয় নেই মায়ি।’

মহান এই বিপ্লবীকে সবাই পছন্দ করতেন। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও তাঁকে সমীহ করতেন। অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের মধ্যে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বিরোধ ছিল। কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে কারও বিরোধ ছিল না। অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বগুণে তিনি তা অর্জন করেছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো বিশ্ববরেণ্য নেতারা তাঁকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। মহারাজকে শ্রদ্ধা করতেন বাংলার আরেক স্বাধীনতাকামী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মহারাজ শুধু বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি একাধারে লেখক, কবি, চিন্তাবিদ, একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি যেমন কবিতা লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন গীতার ভাষ্য। লিখেছেন জেলখানার অভ্যন্তরীণ সমস্যা-সংকট নিয়ে। স্কুলের জন্য পাঠ্যবইও রচনা করেছেন। সবকিছু ছাপিয়ে ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বইটির জন্য তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কালের বিবর্তনে গ্রন্থটি অগ্নিযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস জানতে হলে বইটির পাঠ আবশ্যিক। অন্যথায় তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

অসামান্য দেশপ্রেমিক এ মানুষটি ব্রিটিশ শাসনের সময় তিরিশ বছর জেল খেটেছেন। আত্মগোপনেও থেকেছেন পাঁচ-ছয় বছর। এরপর স্বাধীন দেশেও তাঁকে অত্যাচার-নির্যাতন সইতে হয়েছে। পাকিস্তান সরকার তাঁকে কারা অন্তরীণ করেছে। আজীবন অকৃতদার মহারাজ মানুষের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সমাজ, উন্নত সমাজ নির্মাণের জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন। মৃত্যুর অল্প কয়েক দিন আগে চিকিৎসার জন্য ভারত যান তিনি। সেখানে পাকিস্তানি শাসক দ্বারা নির্যাতিত পূর্ববাংলার মানুষের পাশে থাকার জন্য ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানান। তবে সে আহ্বান প্রকাশ্যে ছিল না। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে তিনি আলোচনা করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। তাঁর পাশে থাকার জন্য তাদের প্রতি আহ্বানও জানান।
১৯৭০ সালে জীবনসায়াহ্নে উপনীত মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী চিকিৎসার উদ্দেশ্যে প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতে যাওয়ার প্রাক্কালে এক বিবৃতি দেন। এটিই তাঁর জীবনের শেষ বিবৃতি। ১১ জুন বিবৃতিটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়। সে সময় পাকিস্তানে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছিল। ’৭০ সালের এই নির্বাচনটি ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহারাজের বিবৃতিটি ছিল এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই। আগামী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি দেশবাসীকে সৎ ও দেশপ্রেমিক লোকদের নির্বাচিত করার আহ্বান জানান। 

১৯৭০ সালের ২৪ জুন যশোরের বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে মহারাজ ভারতে প্রবেশ করেন। এ সময় সীমান্তে উপস্থিত ভক্তবৃন্দ অশ্রুসজল চোখে তাঁকে বিদায় জানান। ভারতে পৌঁছে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন তিনি। নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, পুরোনো বন্ধু, সহযোদ্ধা, আত্মীয়স্বজনদের সাক্ষাৎ দিচ্ছেন, কথা বলছেন, সংবর্ধনা নিচ্ছেন, সেই সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ হয় ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আর সময় নেই, তাই সবকিছু দ্রুততার সঙ্গে চালিয়ে যান। দিল্লিতে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসকেরা তাঁকে বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের বারণ মানেননি। প্রায় ৪৭ দিনে ভারত সফরে তিনি এক দিনও বিশ্রাম নেননি। প্রতিটি দিন পার করেছেন অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে। এ সময় তিনি ভারতের পার্লামেন্টে ভাষণ দেন। এটি তাঁর জন্য বিশাল এক প্রাপ্তি। মৃত্যুর তিন দিন আগে ১৯৭০ সালের ৬ আগস্ট দিল্লিতে পার্লামেন্টে সংবর্ধনার উত্তরে তিনি এই ভাষণ প্রদান করেন। 

৯ আগস্ট দিল্লিতে শ্রী সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের বাসভবনে মহারাজের সম্মানে এক সংবর্ধনা ও ভোজসভার আয়োজন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, জগজীবন রাম, সিপিআই নেতা ভূপেশ গুপ্ত, ত্রিদিব চৌধুরী, ডা. ত্রিপুরা সেন, কে কে শাহ্, শ্রী উমা শংকর দিক্ষিত ও নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলে ডেপুটি লিডার আকবর আলী খান। মহারাজ তাঁদের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। স্মৃতিচারণাও করেন তিনি। রাত সাড়ে দশটায় ভোজসভার সমাপ্তি ঘটে। এদিন রাতেই ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ৯ আগস্ট রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মহারাজ।

লেখক : ফয়সাল আহমেদ, সম্পাদক ‘এবং বই’ ও রিভার বাংলা

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অবশেষে বাজারে আসছে একাদশ শ্রেণির পাঁচ আবশ্যিক বই - dainik shiksha অবশেষে বাজারে আসছে একাদশ শ্রেণির পাঁচ আবশ্যিক বই অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে রেলগেট অবরোধ তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে রেলগেট অবরোধ তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে - dainik shiksha আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে - dainik shiksha ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি - dainik shiksha কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0021519660949707