বর্ণিল সাজে সেজেছে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। যাত্রীদের জন্য উন্নত সেবা ও আধুনিক অবকাঠামো নিয়ে প্রস্তুত দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। আধুনিক এ অবকাঠামোটির শনিবার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে যাত্রীরা এর উপকার ভোগ করতে পারবেন ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে। এটি চালু হলে আকাশপথে যোগাযোগ উন্নত হবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান জানান, নির্ধারিত সময়ের আগেই আজ এর সফট ওপেনিং বা আংশিক উদ্বোধন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করবেন। এ উপলক্ষে বিমানবন্দরে নিরাপত্তাসহ সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
টার্মিনালটি উদ্বোধনের পর আজ এ এলাকায় একটি জনসভা হওয়ার কথা ছিল। তবে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে জনসভাটি পিছিয়ে ১৪ অক্টোবর একই স্থানে অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। ইতোমধ্যে তৃতীয় টার্মিনালে বসানো হয়েছে বোর্ডিং পাস ইস্যু কাউন্টার, আর্চওয়ে গেট, চেকিং কাউন্টারসহ বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রাংশ। চালানো হচ্ছে এগুলোর পরীক্ষামূলক ব্যবহার। এসব আধুনিক সুবিধা বাংলাদেশের যাত্রীরা সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ের মতো বিমানবন্দরগুলোতে উপভোগ করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘিরে পরীক্ষামূলকভাবে উদ্বোধনী ফ্লাইট পরিচালনার প্রস্তুতি নিয়েছে দেশের রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন শেষে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট এ টার্মিনাল ব্যবহার করে ঢাকা ত্যাগ করবে। সেই ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংও করবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শফিউল আজিম জানান, ইতোমধ্যে এ টার্মিনালের পরীক্ষামূলক নির্বিঘ্ন ব্যবহার নিশ্চিতে বুধবার থেকে ফ্লাইট পরিচালনের মহড়া চলছে। এরই অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার এ টার্মিনাল ব্যবহার করে ঢাকা থেকে বিমানের একটি ফ্লাইট নেপালের কাঠমান্ডু যায়। তবে ওই বিমানের যাত্রীদের বোর্ডিং কার্ড বিতরণ ও ইমিগ্রেশন দ্বিতীয় টার্মিনালে সম্পন্ন হয়েছে। নতুন এ টার্মিনালের কর্মীদের পোশাকেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এদিকে বেবিচক জানায়, বাংলাদেশে ভ্রমণ করা যাত্রীদের এতদিন বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থার মূল্যায়নে এ বিমানবন্দরটি বরাবরই পিছিয়ে ছিল। যাত্রী সেবার মান নিয়ে ছিল বিস্তর অভিযোগ। গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংসহ যাত্রীদের লাগেজ নিয়ে ছিল ভোগান্তি। বিমানবন্দর ও উড়োজাহাজ সংস্থা নিয়ে রেটিং সংস্থা স্কাইট্র্যাক্সের মূল্যায়ন অনুযায়ী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির মান গড়ের নিচে দেওয়া হয়েছে। ১০ পয়েন্টের মধ্যে ৪ পেয়েছে এ বন্দরটি। বন্দরটির কর্মচারীদের ব্যবহার খুবই নিম্নমানের। বিশেষ করে সুযোগ পেলে নিরীহ যাত্রীদের হয়রানি ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
তবে নতুন টার্মিনালের প্রধান লক্ষ্য যাত্রীসেবা নিশ্চিত করা। আর সে জন্য পেশাদার বেসরকারি বিদেশি সংস্থাকে এ কাজে নিয়োগ করা হবে। যাতে যাত্রীদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা যায়। নতুন টার্মিনাল হবে যাত্রীবান্ধব, সহজ, আধুনিক সুবিধা ও উন্নত সেবার উদাহরণ। বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, এ টার্মিনালের যাত্রীদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিতে পেশাদার বিদেশি একটি সংস্থাকে নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে তদারকির দায়িত্বে থাকব আমরা। বন্দরের অন্য সব সংস্থা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে। যাত্রীদের সুবিধার জন্য বেবিচক তার জনবল বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। এর পর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। আর বাকি টাকার জোগান দিচ্ছে সরকার। টার্মিনালটির নির্মাণকাজ করছে জাপানের মিতসুবিশি ও ফুজিতা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং।
নতুন এ টার্মিনালের যাত্রীদের সুবিধার কথা জানিয়ে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান জানান, বিশ্বমানের এ টার্মিনাল ঘিরে আগ্রহ বাড়ছে বিদেশি এয়ারলাইন্সের। এতে কমবে ঢাকা থেকে বিভিন্ন ফ্লাইটের ভাড়া। ফলে অর্থ সাশ্রয় হবে যাত্রীদের। বেবিচক-সংশ্লিষ্টরা জানান, আজ সফট ওপেনিং হলেও যাত্রীরা এ টার্মিনাল এখনই ব্যবহার করতে পারবেন না। এ টার্মিনালের পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করার পর কয়েকবার পরীক্ষামূলকভাবে এটি ব্যবহার করে দেখা হবে। এর পর আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (আইকাও) এ টার্মিনালটি অনুমোদনের জন্য আবেদন জানানো হবে। আইকাও পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলে পূর্ণরূপে এ বন্দরটির কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে। কর্তৃপক্ষের আশা, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে। এটি অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখবে।
৩০ লাখ বর্গফুট জায়গায় তিন তলাবিশিষ্ট এ টার্মিনাল ভবনটির আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার এবং লম্বা ৭০০ মিটার ও চওড়া ২০০ মিটার। এ ভবনটির নকশা করেছেন রোহানি বাহারিন। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিঙ্গাপুরের সিপিজি করপোরেশন প্রাইভেট লিমিটেডের স্থপতি। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি, ভারত, ফিলিপাইন, চীন, ভিয়েতনাম, মালদ্বীপের ভেলানাসহ বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরের নকশাও করেছেন তিনি। তবে নান্দনিকতায় ঢাকার তৃতীয় টার্মিনাল ছাড়িয়ে গেছে থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি ও তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরকেও। বিমানবন্দরে এ টার্মিনাল ভবনে প্রথম পর্যায়ে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ চালু করা হবে। পরবর্তী পর্যায়ে আরও ১৪টি বোর্ডেং ব্রিজ স্থাপন করা হবে। বহির্গমনে মোট ১১৫টি চেক ইন কাউন্টার থাকবে। এর মধ্যে ১৫টি থাকবে সেলফ সার্ভিস চেক ইন কাউন্টার। আগমনী লাউঞ্জে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেক ইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি পাসপোর্ট চেক ইন কাউন্টার থাকবে। এ টার্মিনালটিতে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল সেন্টার থাকবে, যা দিয়ে পুরো হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরটি মনিটরিং করা সম্ভব হবে। বর্তমানে বিমানবন্দরটিতে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল সেন্টার সংক্রান্ত কোনো সুবিধা নেই।
এ ছাড়াও ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টারসহ মোট ৬৬টি ডিপার্চার ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকবে। তৃতীয় টার্মিনালের সঙ্গে মাল্টিলেভেল কার পার্কিং ভবন নির্মাণ করা হবে। সেখানে প্রায় ১ হাজার ২৫০টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। তৃতীয় টার্মিনাল ভবনের ভেতরেই ভিভিআইপি ও ভিআইপিদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন আলাদা নির্ধারিত অংশ থাকবে। মুভিং ওয়াকার, এস্কেলেটর, এলিভেটর, ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম, সিকিউরিটি সিস্টেম, ইমিগ্রেশন সিস্টেমসহ সব আধুনিক ও অটোমেটেড সিস্টেম এখানে সংযুক্ত হতে যাচ্ছে।
শুধু তৃতীয় টার্মিনাল দিয়ে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া এই টার্মিনালের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য আশকোনার হজক্যাম্প থেকে একটি টানেলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। অচিরেই এর কাজ শুরু করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম জানান, টার্মিনাল-৩ এর উদ্বোধনের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রস্তুত। টার্মিনাল-৩ এর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য নতুন যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে।