বিমানের প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত মহাব্যবস্থাপক ও এমডির পিয়ন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দুদিক থেকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। একদিকে ফাঁস করেছেন বিমানের ক্ষমতাধর এমডি মো. যাহিদ হোসেনের ক্ষমতাধর এমএলএসএস (পিয়ন) জাহিদ হাসান। আরেকদিকে ফাঁস করেছেন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য তাইজ ইবনে আনোয়ার। দুই হাত থেকে নিমেষে শত হাতে পৌঁছে যায় প্রশ্নপত্র। ফাঁসকারীদের পকেট ভারী হয়েছে, কিন্তু চুনকালি পড়েছে সরকারের মুখে। মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারি) দেশ রুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।  প্রতিবেদনটি লিখেছেন আশরাফুল হক। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ক্ষমতাধর এমডি পদ ফসকে যাওয়ার পথে ‘জামাই আদরে’ ফিরেছেন মন্ত্রণালয়ে। আর এমডির পিয়নকে পাঠানো হয়েছে জেলে। কর্তা যাহিদ ‘স্বর্গে’ গেছেন, কর্মী জাহিদ বলির পাঁঠা। আর তাইজ ইবনে আনোয়ার ফিরেছেন নিজের ঘরে। এক যাত্রায় কত ফল!

গত বছর ২১ অক্টোবর ছিল বিমানের ১৪৮টি পদে নিয়োগ পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা রাস্তায় নেমে এলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপর হতে বাধ্য হয়। জনরোষের ভয়ে বিমানও এবার পারেনি দায়সারা তদন্ত করতে। তাদের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে কীভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির দুদিক থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে তদন্ত শেষ করার চেষ্টা করা হলেও, এমডিকে দায়মুক্তি দিতে পারেনি কমিটি। তারা বলেছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেনি। কমিটির কারোর দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট বা লিখিতভাবে বণ্টন করা হয়নি।

দায়িত্ব বণ্টন না করে গোলেমালে পরীক্ষা নেওয়ার অর্থ হচ্ছে বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কাউকে সুযোগ করে দেওয়া। এর দায় সংস্থাপ্রধান হিসেবে এমডি এড়াতে পারেন না। এমডির পিয়নকে ফটোকপি করার কাজে ব্যবহার করার নির্দেশ কে দিয়েছে এ প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না তদন্ত কমিটি। বিমানের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা যাহিদ হোসেন। এমনকি তিনি এমডি, সিইও, পরিচালক (প্রশাসন) থেকে শুরু করে প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড লজিস্টিক সাপোর্ট, মার্কেটিং অ্যান্ড সেলসের পরিচালকও। উপসচিব হিসেবে প্রেষণে বিমানে গিয়েছেন। প্রেষণে থেকেই যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এখন অপেক্ষা করছেন সচিব পদে পদোন্নতির জন্য। গত জুলাইয়ে যাহিদ হোসেন নিজ ক্যাডারের আবু সালেহ মোস্তফা কামালের স্থলাভিষিক্ত হন।

২১ অক্টোবর প্রশ্নপত্রের কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়। গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েন প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত নিচের সারির কর্মচারীরা। গত ৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যাহিদ হোসেনকে বিমান থেকে তুলে নিয়ে পদায়ন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদে। যদিও গতকাল সোমবার পর্যন্ত তিনি সেখানে যোগ দিতে পারেননি। বিমান-পরিস্থিতির কারণেই তাকে মন্ত্রণালয়ে যোগ দিতে বাধা দিচ্ছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। যাহিদ হোসেনকে বদলি করার পর বিমানের এমডি পদে যোগ দিয়েছেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব শফিউল আজিম।

বিমানের নিজস্ব কর্মকর্তারা সংস্থাটির গুরুত্বপূর্ণ পদে খুব একটা পদোন্নতি পান না। প্রশাসন ক্যাডার ও বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রেষণে গিয়ে দায়িত্ব পালন করেন। এতে বিমানের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ। তাইজ ইবনে আনোয়ার ছিলেন উপমহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা)। মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব (জিএসই-গ্রাউন্ড সার্ভিস ইক্যুইপমেন্ট) ছিল তার অতিরিক্ত দায়িত্ব। পরিচালকের (প্রশাসন) কক্ষে রাখা প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তার জন্য সিকিউরিটি গার্ডের ব্যবস্থা করেন তাইজ। তিনি তার দুই ড্রাইভারকে প্রশ্নফাঁস করতে সহায়তা করেছেন বলে তারা অভিযোগ তুলেছেন এবং প্রমাণাদি গোয়েন্দা ও তদন্তকারীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এ অবস্থায় গত রবিবার তাইজকে তার মূল দায়িত্বে ফিরিয়ে নিয়ে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় মাহমুদুল হাসানকে।

২১ অক্টোবর নিয়োগ পরীক্ষার দুদিন আগে (১৯ অক্টোবর) প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত করা হয়। চারজনের নিয়োগ কমিটি বৈঠক করে জিএম অ্যাডমিন মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মদের রুমে। জিএম জিএসই তাইজ ইবনে আনোয়ারের অনুরোধে জিএম অ্যাডমিনের ব্যবহৃত প্রিন্টার থেকে প্রশ্নপত্রের প্রিন্ট দেওয়া হয়। ফাইনাল চেকের জন্য প্রশ্নটি জিএসইকে দেওয়া হয়। চেক শেষে যদিও শ্রেডিং মেশিনে তা ধ্বংস করা হয়।

চার সদস্যের নিয়োগ কমিটির প্রধান প্রকৌশলী এআরএম কায়সার জামান তদন্তকারীদের বলেন, ‘১৯/১০/২০২২ তারিখে আমি যখন জিএম অ্যাডমিনের কক্ষে যাই তখন সেখানে জিএম অ্যাডমিন ও প্রিন্সিপাল বিএটিসি জিএসই অপারেশন পদের প্রশ্নপত্র নিয়ে কাজ করছিলেন। আমার প্রবেশের আনুমানিক ১৫ মিনিট পর জিএম জিএসই প্রবেশ করেন। জিএম অ্যাডমিন, জিএম জিএসইকে প্রশ্নপত্র চেক করতে বলেন। জিএম জিএসই বলেন, একটা প্রিন্টআউট করতে। একটি কাগজের বোথ সাইড প্রিন্ট করা হয়। এর আগে জিএম অ্যাডমিন বলেছিলেন স্ক্রিনে চেক করতে।’ একপর্যায়ে প্রধান প্রকৌশলী ওয়াশরুমে যান। তিনি জিএম জিএসইকে কোনো ছবি তুলতে দেখেননি বলে তদন্ত কমিটিকে জানান।

জিএম অ্যাডমিন মো. নিজাম উদ্দীন আহমেদ তদন্ত কমিটিকে বলেন, আমি কোনো প্রশ্নপত্রের প্রিন্টআউট নিতে চাইনি। যতটুকু মনে পড়ে তাইজ সাহেবের অনুরোধে প্রিন্টআউট বের করা হয়।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ দুজন হলেন এমটি অপারেটর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও মোহাম্মদ মাসুদ। তারা দুজনই ডিজিএম নিরাপত্তা তাইজ ইবনে আনোয়ারের গাড়ির চালক। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তারা বলেছেন, ডিজিএম নিরাপত্তার কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পেয়েছেন।

জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ‘ডিজিএম সিকিউরিটি স্যার মোটরসাইকেলে করে অপারেশন বিল্ডিংয়ে আসেন। ইশারা দিলে আমরা দুজন তার কাছে যাই। আমাকে আর মাসুদকে ভাঁজ করা একটি কপি দেন। উভয় পাশে প্রশ্নপত্র ছাপানো ছিল। আমি ওই প্রশ্নপত্রের স্ক্রিনশট নিতে চাইলে তিনি ধমক দেন এবং প্রশ্নপত্র নিয়ে দ্রুত চলে যেতে বলেন।’

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিয়োগ পরীক্ষার আগের দিন ফটোকপি করার সময় নিজের মোবাইল ফোনে প্রশ্নপত্রের ছবি ধারণ করেন এমডি যাহিদ হোসেনের এমএলএসএস জাহিদ হাসান। পরে তিনি এ প্রশ্নপত্র হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পরিচালক প্রশাসনের দপ্তরের এমএলএসএস সমাজু ওরফে সোবহান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দপ্তরের এমএলএসএস আওলাদ হোসেনকে দেন। তারা তা দ্রুত ছড়িয়ে দেন। সে সময় তারা কারও কাছ থেকে ২ লাখ, কারও কাছ থেকে ১ লাখ টাকা নেন। অনেকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়েও প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেন।

তাইজ ইবনে আনোয়ার তদন্ত কমিটিকে জানান, তিনি শুরুতে প্রশ্নপত্র অন-স্ক্রিন চেক করেছিলেন। পরে প্রিন্ট করা হয়। প্রিন্ট নেওয়ার কারণ ঠিকমতো পেইজে আসে কি না, লেখা ঠিক থাকে কি না এসব বোঝা। জিএম অ্যাডমিন নিজের হাতে প্রিন্ট কপি শ্রেডিং মেশিনে দেন। প্রশ্ন দেখার সময় নিয়োগ কমিটির চারজনই রুমে ছিলেন, কেউ ওয়াশরুমে যাননি।

নিয়োগ পরীক্ষার দিনই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরিচালক অর্থ মো. নওসাদ হোসেনের নেতৃত্বে মহাব্যবস্থাপক সিএসকিউ নিরঞ্জন রায় ও উপমহাব্যবস্থাপক লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স রাশেদ মেহের চৌধুরী গত ২০ নভেম্বর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দেন।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা প্রায় সবাই আটক বা জেলে। বিষয়টি আদালতে বিচারধীন থাকায় আর কিছু বলা সম্ভব নয়।’

তদন্ত কমিটির কাছে ২১ কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনো না কোনোভাবে প্রশ্নপত্র পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। প্রশ্ন পেয়েছিলেন কিন্তু স্বীকার করেননি আটজন। পলাতক থাকায় কিছু কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেনি তদন্ত দল। প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য তদন্ত দলের মাধ্যমে ক্ষমা চেয়েছেন।

১০ ক্যাটাগরির ১৪৮টি শূন্যপদে ভন্ডুল হওয়া লিখিত পরীক্ষায় ৪ হাজার ৩৮৮ জনের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। গত ২১ অক্টোবর পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য তারা উত্তরার হাবিবুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং আইইএস উচ্চ বিদ্যালয়ে জড়ো হন। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হলে পরীক্ষার্থীরা মিছিল বের করেন।

বিমানের নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম নতুন কিছু নয়। বছরজুড়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাটি কর্মী নিয়োগ দেয়। এসব নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। সংস্থাটির বদলি, পদায়ন, কেনাকাটা, লিজ নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

সরকারের বেতন কাঠামোর চেয়ে খানিকটা বেশি বেতন এ সংস্থায়। কিন্তু এর কর্মীদের মধ্যে ‘ওনারশিপ’ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রায় প্রতি মাসেই সংস্থার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো মামলা হচ্ছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও - dainik shiksha ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল - dainik shiksha বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক - dainik shiksha এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026211738586426