সামনে আরো বিশাল উন্নয়নযজ্ঞের অপেক্ষায় ৩০৪ দশমিক ২১ একর জমির ওপর অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশসেরা বিদ্যাপীঠটির শতবর্ষপূর্তি ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এর মল চত্বরে তৈরি হবে ‘সেনটেনারি মনুমেন্ট’। ২৫ ফুট উচ্চতার স্তম্ভটির বেদির আয়তন হবে ৭ হাজার ২০০ বর্গফুট। দৈর্ঘ্য হবে ৭০ ফুট, প্রস্থ ৩০ ফুট। স্মৃতিস্তম্ভটির ওয়াটার গার্ডেনের ব্যাস ৬০ ফুট। গভীরতা ৫ ফুট। একটি বিশেষায়িত জুরিবোর্ডের মাধ্যমে স্থাপত্য নকশা নির্বাচন করা হয়েছে। মল চত্বর এলাকার গাছপালা ঠিক রেখেই হবে পেভমেন্ট, রোড, ড্রেন ও বৈদ্যুতিক কাজ। এখানে কেবল শিক্ষার্থীদের বসার ব্যবস্থা নয়- সাইকেল স্ট্যান্ড, রিসাইকেল বিন, চার্জিং পয়েন্টসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকবে। ১৫ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনায় ৫৯৯টি পুরনো স্থাপনা ভেঙে ৯৭টি উঁচু ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৯টি ১০ তলা ভবন বা তার চেয়েও উঁচু। মহাপরিকল্পনায় নতুন একাডেমিক ভবন ছাড়াও আছে একটি আধুনিক গ্রন্থাগার, আধুনিক সুবিধা সংবলিত চিকিৎসা কেন্দ্র, জিমনেসিয়াম, মেয়েদের জন্য সুইমিং পুল এবং গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। ধবার (৮ ডিসেম্বর) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, ইট-সুরকির মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হবে ৩ ধাপে। প্রথম ধাপে মোট ২৮টি ভবন হবে, যার মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ২০ তলার একটি প্রশাসনিক ভবনও রয়েছে। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের উত্তর-পশ্চিম অংশটি ভেঙে সেখানে ১২ তলা ভবনের প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়া মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাবি ক্যাম্পাস মূল ক্যাম্পাস শাহবাগ, কাঁটাবন, পলাশী এবং কার্জন হল এলাকায় ২৭৬ দশমিক ২৮ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সংক্ষিপ্ত এ বর্ণনায় যে কারো কাছেই এই প্রকল্পযজ্ঞের অবয়ব আঁচ করা সহজ।
কেবল সৌন্দর্য বাড়ানো, পড়াশোনা করা ও করানো আর পাস করিয়ে বের করে দেয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়। আলোচিত কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সময়ের চাহিদামতো গবেষণার মান কি প্রাসঙ্গিক? একাডেমিক চাহিদার সঙ্গে আছে কোনো যোগসূত্র? বিশ্বে কম বিশ্ববিদ্যালয়ই আছে, যারা কোনো দেশের বা জাতির রাজনীতি-সমাজ এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পেরেছে। সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য বা বৈশিষ্ট্য আলোচনায় এলেই রাজনীতি প্রাধান্য পায়। ঔপনিবেশিক শাসনের শেষদিকে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে শিক্ষাই মূল উদ্দেশ্য ছিল না। এর একটা রাজনৈতিক দিকও ছিল। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ১৯০৫ সালে পূর্ববাংলা ও আসামকে নিয়ে আলাদা প্রদেশ গঠন ও বঙ্গভঙ্গ বাতিলের যোগসূত্র আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৭ বছর পর এদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। ব্রিটিশ এবং পরে পাকিস্তান আমলে এই অঞ্চলের মানুষের পিছিয়ে থাকা এবং সেই অসামঞ্জস্য দূর করার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। বাংলা ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ গণতান্ত্রিক বা জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সব আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং পরে পাকিস্তানের শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ইতিহাসের অংশ। সেই ঐতিহাসিক কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আলোচনা হলে শিক্ষা বা গবেষণার বিষয়ের তুলনায় রাজনৈতিক ভূমিকা বেশি প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরে বিভিন্ন সরকারের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতিতে দলীয় রাজনীতির প্রভাব এবং শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি বা ব্যক্তিস্বার্থের নানা অভিযোগ উঠেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর বছর উচ্চশিক্ষিত মানুষ তৈরি করলেও গবেষণার বিষয়টি উপেক্ষিত। শিক্ষকদের অনেকে সুবিধাজনক পদ পেতে দলীয় রাজনীতিতে বেশি সময় দিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলো শুধু রাজনীতি করত না, তা শ্রেণিকক্ষের বাইরে পাঠ্যবহির্ভূত বিষয়েও ভূমিকা রাখত। দিনকে দিন পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা বা শিক্ষা কার্যক্রমকে হুমকির মুখে ফেলছে। বিপরীতে ছাত্র রাজনীতির নামে দলীয় আনুগত্য নিয়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং নানা অনিয়ম বা দুর্নীতি ডালপালা ছড়িয়েছে। তা বাংলাদেশের শুরু থেকেই। দলীয় রাজনীতির প্রভাব বেড়ে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে অবক্ষয় এনেছে। আদর্শের বদলে লোভ, ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ বড় বিষয় হয়েছে। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অনিয়ম বাড়িয়েছে। আর শিক্ষা-গবেষণার ক্ষেত্রকে করেছে সংকীর্ণ। বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে সময়ে সময়ে করা জরিপ বা প্রতিবেদনেও এই দুঃখজনক চিত্র উঠে আসছে।
বাংলাদেশের ‘সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ’ নামে প্রচারিত হলেও শিক্ষার পরিবেশ ও গবেষণার সাফল্যের কেবলই অবনমনে। বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং নির্ধারণ করা টাইমস হায়ার এডুকেশনের দেয়া রিপোর্টগুলোতে বারবার সেই কলঙ্কের প্রকাশ ঘটছে। লন্ডনভিত্তিক শিক্ষাবিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন গত বছরের করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ে দেখা গেছে গত চার বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ক্রমাগত অবনতির দিকেই যাচ্ছে। টাইমস হায়ার এডুকেশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিচিংয়ের (শিক্ষার পরিবেশ) ক্ষেত্রে ২১.৭ স্কোর করেছিল। ২০১৮ সালে সে স্কোর কমে হয়েছে ২০.৪। নামতে নামতে সেটা ১৬ স্কোরে এসে ঠেকেছে। মান অবনতির সবচেয়ে বড় কারণ হলো শিক্ষায় রাজনৈতিক প্রভাব। এর পেছনে গবেষণা, অবকাঠামো, বাজেট, যোগ্য শিক্ষক এবং ছাত্র শিক্ষক অনুপাত ইত্যাদিও কম ফ্যাক্টর নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণায় বরাদ্দ কি কমেছে? তাও নয়। বেড়েছে। তা বছর বছর আরো বাড়ছে।
কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশে শিক্ষার সামগ্রিক মানের অবনতি বুঝতে কোনো জরিপ জরুরি নয়। তা দুর্বোধ্যও নয়। সমস্যাটা স্বীকার না করার একটি মানসিকতা রয়েছে। সমস্যা স্বীকার না করলে সমাধান আসবে কোত্থেকে? এক সময় অনায়াসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা হতো। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার সব পর্যায়ে একই সূত্রে গাথা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মানের অবনতির ফলে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেছে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিক্ষার জ্ঞানের অভাব শিক্ষার মানকে নিম্নমুখী করেছে। বাংলা ভাষায় রচিত হয়নি পাঠ্য ও সহায়ক গ্রন্থ; বাংলা ভাষাকেও সমধিক গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এতে অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নিম্নমানের শিক্ষক নিয়োগ শিক্ষা-গবেষণার জগতে যে সংকট তৈরি করেছে তা অস্বীকার করা মানে বাস্তবতাকে চাপা দেয়া। এরপরও মানসিক বাস্তবতা হচ্ছে জরিপে এশিয়া বা বিশ্ববাসীর তালিকায় নাম যেখানেই থাক, বাঙালির চোখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকতায়। তাই তো এর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতি এখনো অটুট।
লেখক : মোস্তফা কামাল, সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।