বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় এককোটি; জনসংখ্যার প্রায় ৭ শতাংশ। ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দে হবে চার কোটিরও বেশি। প্রকৃতির খেয়ালে যৌবন গড়ায় বার্ধক্যে। অন্যদিকে, অসহায় প্রবীণের মনে আঘাত দিলে সব শুভ তৎপরতা হয় নিষ্ফল: ‘...একটি মানুষে খুশি করা, আর হজ করে আসা হাজার বার...ব্যথিত বুকের হাহাকার, আর অশ্রু চোখের-ফুল ঝরে যায়, পানি যে শুকায়...টলমল করে খোদার আরশ, ব্যথিত যখন রোদন করে।
আজ ‘বিশ্ব প্রবীণ দিবস’। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে দিবসটি পালিত হচ্ছে। প্রবীণরা Senior Citizen। পরিবারে কারো কারো স্বার্থ-ভাবনায় প্রবীণরা যেনো ‘কঠিন ঝামেলা’। বর্তমানে তৈরি হয়েছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ ধারণা। ‘বৃদ্ধাশ্রম’ আমাদের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় কি? নানান রকম জিনিস, বিদেশি কুকুর, দামি আসবাবের সঙ্গে মুরুব্বিদের জন্য যেনো নেই জায়গা।
নচিকেতার কটাক্ষ:
‘...স্বামী-স্ত্রী আর অ্যালসেশিয়ান-জায়গা বড়ই কম-আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম’।
ইসলামের শিক্ষা: উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নগরায়ন ও বহুমুখী কর্মব্যস্ততায় আমাদের মধ্যেও চিরচেনা পারস্পরিক দায়বদ্ধতা লোপ পাচ্ছে। শোনা যায় প্রবীণদের নীরব হাহাকার। তবে প্রবীণদের সমস্যা সমাধানে ইসলামি দর্শনই যথার্থ। মহান আল্লাহর নির্দেশ ‘পিতামাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। তোমাদের সামনে তাদের একজন বা উভয়েই যদি বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাদের প্রতি ‘উহ্’! শব্দটি উচ্চারণ করবে না। তাদের সঙ্গে কর্কশ ভাষায় কথা বলবে না। তাদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে বিনয়ের বাহু প্রসারিত করে দেবে। আর তাদের সম্পর্কে বলবে: হে প্রভু; তাদের ওপর সদয় হোন। যেমন-শিশুকালে তারা আমাদের প্রতি সদয় ছিলেন।’
পিতামাতার ঋণ শোধ করবার নয়। মহান আল্লাহ বলেন ‘মা সন্তানকে কষ্টের ওপর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করেছেন। সুতরাং..... সে যেনো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে’ পিতামাতার সেবার মাধ্যমেই মহান আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। প্রিয় নবী (স.) বলেন, ‘পিতামাতার সন্তুষ্টিই আল্লাহর সন্তুষ্টি, পিতামাতার অসন্তুষ্টিই আল্লাহ্র অসন্তুষ্টি’ (তিরমিযি)। তিনি (স.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃদ্ধকে তার বয়সের কারণে সম্মান করলো, আল্লাহও অন্যের দ্বারা তাকে সম্মানিত করবেন’ (আবুদাউদ)।
এক সময় জীবন-যৌবন লুটিয়ে যারা সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়েছিলেন। এক সময় পিতামাতার প্রার্থনা ছিলো: ‘হে প্রভু! দাও যে এমন স্ত্রী-সন্তান (পরিজন) ওদের সবাই যেনো, শীতল করে, শুধুই মোদের নয়ন’ (কাব্যানুবাদ, ফুরকান-৭৪)।
আজ তারা বড়ই একা ও অপাঙক্তেয়। অথচ প্রবীণদের প্রত্যাশা থাকে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটুক সন্তান-স্বজন স্বীকৃত ও পরিবেষ্টিত নিরাপদ আশ্রয়ে। অথচ ‘প্রীতি প্রেমের পূণ্য বাঁধনে’র চিরায়ত ভাবনা বদলের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ‘স্বর্গীয়’ সুখ!
আইনি প্রতিবিধান: ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩, ৩ নম্বর ধারার সারসংক্ষেপ:
১. সন্তানকে পিতামাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে। ২. একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে, সন্তানরা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে পিতামাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করবে। ৩. পিতামাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিতকল্পে সন্তানের একইস্থানে, এক সঙ্গে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে। ৪. পিতামাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে বৃদ্ধনিবাস বা অন্যত্র বসবাসে বাধ্য করা যাবে না। ৫. সন্তান নিয়মিত পিতামাতার চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করবে। ৬. পিতামাতা অন্যত্র থাকলেও সন্তান নিয়মিত তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করবে। ৭. সন্তান নিয়মিত তার আয়-রোজগার হতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতামাতাকে প্রদান করবে।
‘পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩’ এর ধারা-উপধারা সন্তান কর্তৃক লঙ্ঘন, অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত, অনাদায়ে তিন মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
পিতামাতার ভরণ-পোষণে বাধাদান/অসহযোগিতার জন্য সন্তানের স্ত্রী/স্বামী/নিকট আত্মীয়ও উক্তরূপ অপরাধ সংঘটনে সহায়তাকারী হিসেবে গণ্য এবং আইনে বর্ণিত দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
পরিশেষে মনের গভীরের অনুরণ: ‘বলো কি তোমার ক্ষতি, জীবনের অথৈ নদী, পার হয় তোমাকে ধরে, দুর্বল মানুষ যদি...’।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ