আবু হাসনাত তুহিন, দৈনিক শিক্ষাডটকম: পৃথিবীব্যাপী আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। মানুষের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি পশু-পাখিদের চিকিৎসাও একটি মহৎ পেশা। আর এই মহৎ পেশায় নিয়োজিত ভেটেরিনারিয়ানদের অক্লান্ত মেধা ও পরিশ্রমেই দেশের প্রাণীসেবা এগিয়ে চলছে। যোগান চলছে প্রোটিন-আমিষের। দেশের লাইভস্টক খাতকে এগিয়ে নিতে ভেটেরিনারিয়ানদের এই শ্রমকে আরো যুগোপযোগী করতে আজ দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। দিবসটি ঘিরে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থীদের ভাবনায় আজকের আয়োজন।
স্বপ্ন বুননে ভেটেরিনারিয়ান
ভেটেরিনারিয়ানরা শুধু প্রাণীরই চিকিৎসা করে না, তারা পরিচর্যা করেন জীবনকে বদলে দেয়ার মতো এক একটি স্বপ্নের, ছোট থেকে বেড়ে ওঠা এক একটি শখের, এক একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ ভাবনার।
একটি খামারি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের স্বপ্ন বেড়ে ওঠে তাদের পালিত পশুগুলোকে ঘিরেই। খামারিরা যখন একটি সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনে এগিয়ে যায়, তখন ভেটরা তাদের পরামর্শ প্রদান থেকে শুরু করে জৈব নিরাপত্তা, পশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। সেই সাথে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, গুরুতর ক্ষেত্রে জটিল অস্ত্রোপচার ও যথোপযুক্ত চিকিৎসা প্রদানে সব সময় খামারিদের পাশে থাকেন। এভাবেই একজন উদ্যোক্তার ছোট থেকে মাঝারি, মাঝারি থেকে বড় খামারি হয়ে ওঠার প্রতি ধাপেই রয়েছে ভেটদের অবদান।
এবার আসা যাক শখের দিকটায়। মানুষের সাহচর্যে থাকায় বিড়াল, কুকুরসহ অন্যান্য পশুও তাদের শখের জায়গাটা দখল করে রাখে। চিড়িয়াখানায় চিত্তবিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তো আছেই। এই পশুদের শারীরিক চিকিৎসায় ভেটরা যথোপযুক্ত ভুমিকা রাখে।
"Veterinarians are essential health workers" প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারের বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবসে পশু ও মানুষ উভয়ের সেবায় নিয়োজিত সুন্দর হৃদয়ের অধিকারী সেসব ভেটদের জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস ২০২৪ সফল হোক।
কাজী মেহেদী হাসান হৃদয়, সেশন- ২০২২-২৩, ডিভিএম, পবিপ্রবি
মানবকল্যাণে প্রাণী চিকিৎসক
মানুষের রোগ-বালাইয়ে যেমন এমবিবিএস ডাক্তাররা ট্রিটমেন্ট দিয়ে থাকে, তেমনই পশু-পাখিদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা দিয়ে থাকে ডিভিএম ডাক্তাররা। কিন্তু তবুও মানবকল্যাণে অনেকবার সামনে এসেছে ভেটেরিনারিয়ানদের নাম। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যতো মহামারী দেখা দিয়েছে তার অধিকাংশই প্রাণী থেকে মানুষে স্থানান্তরিত হয়েছে। এইতো কিছুদিন আগের কোভিড-১৯ ভাইরাসসহ সোয়াইন ফ্লু, নিপাহ, ইবোলা, মার্স, সার্স, র্যাবিস, অ্যানথ্রাক্স, বোভিন টিবি, মারবুর্গ, লেপটোসিরোসিস এই সকল বড় বড় মহামারির উৎস প্রাণী। এসব মহামারিতে অতীতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে। এসব ভাইরাসঘটিত রোগকে জুনোটিক ডিজিজ বলা হয়।
মানবকল্যাণে ভেটেরিনারিয়ানরা এসব রোগের উপর গবেষণা করছে। পৃথিবীর প্রাণিকুলের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত না থাকলে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে না, কারণ মানুষ আমিষ এবং প্রোটিনের জন্য প্রাণীকুলের উপরই শতভাগ নির্ভরশীল। মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিকুলের সুস্থতা প্রয়োজন সবার আগে। এজন্য প্রাণী স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিওভিএ) যৌথভাবে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর এনিমেল হেলথ (ওআইই), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) এবং ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) সঙ্গে সারাবিশ্বে কাজ করে যাচ্ছে।
ভেটেরিনারিয়ানরা অনেক আগে থেকেই ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, র্যাবিস, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজের মতো বিভিন্ন জুনোটিক ডিজিস নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, রোগপ্রতিষেধক টিকা এবং প্রতিকারের উপায় বের করতে ভেটেরিনারিয়াদের অবদান অনস্বীকার্য। এ পর্যন্ত যতোগুলো টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে, তার সবই প্রাণিসম্পদের ওপরই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল।
সাদাফ তাজবীর মেহেদী, সেশন- ২০২০-২১, ডিভিএম, পবিপ্রবি
কোয়াকমুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি
বহু বছর আগে থেকেই ভেটেরিনারি চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা, গবেষণা শুরু হলেও থেমে থাকেনি গ্রামের অল্প পড়াশোনা করা, ভেটেরিনারি বিষয়ে পড়াশোনা না করা ব্যক্তিদের নিজেরাই ডাক্তার সেজে চিকিৎসা দেয়ার প্রবণতা। বরং এদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এতে ভুক্তভোগী হচ্ছেন কখনো গরিব অসহায় মানুষ, কখনোবা ধনী ব্যক্তিরাও। কেউ কেউ ডাক্তারদের সহকারী হিসেবে বেশ কিছুদিন কাজ করার পর নিজেরাই নিজেদের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। এতে করে তাদের ভুল চিকিৎসা আর অতিমাত্রায় এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে বলী হচ্ছে ধনীর আদরের বিড়াল, কুকুর থেকে শুরু করে গরিবের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টের টাকা দিয়ে কেনা অবলা গরু কিংবা ছাগল। তাই এখনই সময়, এমন ভুয়া ডাক্তার তথা কোয়াকদের ভুল চিকিৎসা কার্যক্রম রুখে দেয়ার। প্রত্যেক উপজেলাতে প্রায়শই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে এদের চিহ্নিত করতে এগিয়ে আসা উচিত। এবারের বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবসের প্রতিপাদ্যকে বুকে ধারণ করে এক সুরে বলা উচিত – “Veterinarians are essential health workers.”। যথার্থই ভেটেরিনারিয়ানরা হচ্ছেন অপরিহার্য স্বাস্থ্যকর্মী। তারাই পারেন প্রাণীদের সু-চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতে।
সাফওয়ান ইবনে সাজ্জাদ, সেশন- ২০২০-২১, ডিভিএম, পবিপ্রবি
সফল ভেটেরিনারিয়ান
ভেটরা (প্রাণী চিকিৎসক) মূলত প্রাণীদের স্বাস্হ্য সুরক্ষা নিশ্চিত, অসুস্থ প্রাণীর চিকিৎসাসেবা প্রদান, পশুর প্রজনন, পশুর পুষ্টি, টিকা, পরজীবী নিয়ন্ত্রণ, জৈব নিরাপত্তা, জুনেটিক রোগ (প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত রোগ, যেমন-করোনা ভাইরাস) নজরদারি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও মানুষের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত নিয়ে কাজ করে থাকে। ভেটরা নির্দিষ্ট প্রাণী-সহচর প্রাণী, পশুসম্পদ, চিড়িয়াখানার প্রাণী বা পোষা প্রাণী বিষয়ে বিশেষায়িত হতে পারে অথবা অস্ত্রোপচার, চর্মবিদ্যা ও অভ্যন্তরীণ ঔষধের মতো নিখুঁত চিকিৎসা শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ হতে পারে। ভেটরা মূলত প্রাণীদের লক্ষণ দেখেই চিকিৎসা প্রদানে সফল, তবে বর্তমানে তাদের কর্মক্ষেত্র বিশেষ করে ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো আধুনিক যন্ত্রপাতি, ডায়াগনস্টিক চেক, রেডিওগ্রাফি, সিটিস্ক্যান, এমআরআই, রক্ত পরীক্ষা, ইউরিনালাইসিস করে চিকিৎসা করে থাকেন। বিভিন্ন জায়গায় আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ অপারেশন থিয়েটারের মাধ্যমে সফল অস্ত্রপাচার সম্ভব হচ্ছে।
ভেটদের এ সফলতার স্মৃতিগাঁথা হিসেবে বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশনের উদ্যোগে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু হয় সারা বিশ্বব্যপী ভেট ডে উদযাপন। প্রতিবছর এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার সারা বিশ্বব্যপী একযোগে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস পালিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিশেষভাবে এ দিনটি পালিত হয়। ভেটরা এ দিনটিতে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পেইন ও ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে থাকেন। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় -"Veterinarians are essential health workers". মানে ও গুণে DVM ধন্য, প্রাণীর সেবায় ভেটরাই অনন্য। সফল হোক ভেট ডে ২০২৪।
মাহমুদুল হাসান, সেশন- ২০২২-২৩, ডিভিএম, পবিপ্রবি